ডাকসু নির্বাচনে ভিপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গোপন অস্ত্র কোচিং
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:২৬ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আর মাত্র একদিন বাকি।
আজ রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) শেষ হচ্ছে উত্তাপ ছড়ানো প্রচার-প্রচারণা। শেষ মুহূর্তে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের সমীকরণে যুক্ত হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত উপাদান—‘কোচিং ফ্যাক্টর’। কোন প্রার্থী ভর্তি কোচিংয়ের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন নিজের ভোটব্যাংক, তা নিয়ে সরগরম ক্যাম্পাস।
ভিপি পদে ছাত্রীদের ভোট, বিভিন্ন হলের সমর্থন কিংবা জগন্নাথ হলের বিপুলসংখ্যক ভোটারের ঝোঁক—এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আলোচনায় ভর্তি কোচিং সেন্টারের প্রভাবও। প্রার্থীদের মধ্যে কেউ দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় ভর্তি কোচিংয়ে শিক্ষকতা করছেন, কেউ বা রাজনৈতিক সংগঠন-সংশ্লিষ্ট কোচিং পরিচালনায় যুক্ত। ফলে এসব কোচিং থেকে ঢাবিতে ভর্তি হওয়া হাজারো শিক্ষার্থীর ভোটে পাল্টে যেতে পারে শেষ মুহূর্তের সমীকরণ।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বহু বছর ধরে ‘ইউসিসি’ ভর্তি কোচিংয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। অপরদিকে, ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রিত ‘ফোকাস’ কোচিং থেকেও প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাবিতে ভর্তি হয়, যা বাড়িয়ে দিতে পারে সাদিক কায়েমের সম্ভাবনা। স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন ইংরেজি পড়িয়ে ক্যাম্পাসে পরিচিতি পাওয়ায় তারও উল্লেখযোগ্য ভোটব্যাংক রয়েছে।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে ‘ফোকাস’ থেকে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৭৫০ জন ও ‘ইউসিসি’ থেকে প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। গত তিন বছরে এই দুই কোচিং থেকেই ঢাবিতে ভর্তি হয়েছেন অন্তত আট হাজার শিক্ষার্থী—যারা সবাই এবার ভোটার। শিক্ষার্থীদের ধারণা, ইউসিসি থেকে আসা ভোটের বড় অংশ যাবে আবিদুলের ঝুলিতে, ফোকাস থেকে আসা ভোট বেশি পেতে পারেন সাদিক, আর শামীমও ‘ইংরেজি ফ্যাক্টর’-এ নির্ভর করে ভালো অবস্থানে থাকতে পারেন।
‘শিক্ষক’ আবিদুলকে ভিপি পদে দেখতে চান ইউসিসির শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংগুলোর মধ্যে ইউসিসি বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অনেকে ইউসিসিতে ভর্তি হন। প্রতি বছর এ কোচিং থেকে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার শিক্ষার্থী ঢাবিতে চান্স পেয়ে ভর্তি হন। তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আবিদুল ইসলাম খানের ক্লাস করে এসেছেন। ফলে ভিপি পদের লড়াইয়ে তারা আবিদুলকে বেছে নিতে পারেন।
ক্যাম্পাসে প্রচার-প্রচারণার সময়ও আবিদুলকে অনেক শিক্ষার্থী ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে শোনা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা আবিদুলকে বলছেন, তারা ইউসিসিতে তার শিক্ষার্থীরা ছিলেন। নির্বাচনে ভোটটা তাকেই দেবেন।
অন্যদিকে, ইউসিসি গ্রুপ তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে আবিদুলের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন। ভিপি পদে ডাকসুতে তার ‘জয়’ কামনা করেছেন, যা ইউসিসিতে কোচিং করে ঢাবিতে চান্স পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীকে ‘প্রভাবিত’ করেছে বলে মনে করেন খোদ কোচিংটির কর্মকর্তারাও।
নাম প্রকাশ না করে ইউসিসি কোচিংয়ের দুজন কর্মকর্তা জানান, তারা তাদের পরিচিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে আবিদুলের জন্য ভোট চেয়েছেন। তাছাড়া ইউসিসি পরিবারের সদস্যরা আবিদুলকে পছন্দ করবে বলেও মনে করেন তারা।
ইউসিসির সাবেক শিক্ষার্থী আঞ্জুমান আরা ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আবিদুলকে আমরা স্যার হিসেবে চিনি। তিনি রাজনীতি করতো সেটা জানতাম না। যেহেতু উনার ক্লাস করে আমি উপকৃত হয়েছি, উনি অনেক ভালো ক্লাস নিতেন; সেদিক থেকে তাকে ভোট দিতে পারি। বিষয়টি বিবেচনায় আছে।’
ফোকাসের ‘নিয়ন্ত্রক’ শিবির, ভোট পেতে পারেন সাদিক
ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং থেকে প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ কোচিং থেকে প্রস্তুতি নিয়ে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষার্থী ঢাবিতে ভর্তি হয়েছেন। তাদের অনেকে ছাত্রশিবির ও ছাত্রীসংস্থার রাজনীতিতেও জড়িত।
অনেকে সরাসরি রাজনীতিতে না জড়ালেও তাদের দলীয় আদর্শ ‘ধারণ ও লালন’ করেন। ফলে ফোকাস থেকে ঢাবিতে চান্স পাওয়াদের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের ভোট পেতে পারেন ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম।
ডাকসু নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর গত ৩০ আগস্ট ফোকাস কোচিং ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে তাদের কোচিং থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ঢাবিতে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বক্তব্য দেন ছাত্রশিবির প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম, জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ ও এজিএস প্রার্থী মহিউদ্দিন খান।
সেই অনুষ্ঠানে সরাসরি ভোট না চাইলেও সাদিক-ফরহাদ-মহিউদ্দিনকে ‘বিশেষভাবে’ উপস্থাপন করা হয়। নবীন শিক্ষার্থীদের সামনে তারা বক্তৃতা ও গান গেয়ে অনুষ্ঠান মাতিয়ে তোলেন। এ নিয়ে অভিযোগ তোলেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল। যদিও তা ডাকসুর নির্বাচন কমিশনে কোনো পাত্তা পায়নি।
ফোকাস কোচিংয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ফোকাসের এবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রায় ১২০০-১২৫০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। এটি প্রতিবছর করা হয়। ঢাবি ছাত্রশিবিরের নেতাদের অনেকে তাদের কোচিংয়ের পরিচালক। ফলে তাদের উপস্থিতি নতুন কিছু নয়।
ফোকাস কোচিং থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আগে থেকেই শিবিরের প্রতি আমার টান ছিল। আমি তাদের কোনো কর্মী নয়, তবে সমর্থক। সাদিক কায়েমকে ভিপি পদে পছন্দ আমার।
ইংরেজি পড়ানো শামীমও পাবেন ‘কোচিং’ ভোট
সরাসরি ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইংরেজি পড়ান স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী শামীম হোসেন। ফেসবুকে তার ফলোয়ারও অনেক। তারা চাকরির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ইংরেজি শিখতে শামীমের ভিডিও দেখেন নিয়মিত। তার ক্লাসে বোঝানোর ভঙ্গি অনেকের পছন্দ। বিভিন্ন ব্যাচে শামীমের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন। আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে তাদের ভোট পেতে পারেন শামীম।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু কোচিং করে আসায় সেই প্রতিষ্ঠানের সমর্থিত বা আদর্শে উজ্জীবিত কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তা মনে করেন না ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন।
তিনি বলেন, এটা হতেও পারে, নাও হতে পারে। কোচিং অনেকে অনেক জায়গায় করতে পারেন, তাদের সঙ্গে সখ্যতাও থাকতে পারে। কিন্তু ভোটের হিসাবটা ভিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বাধীনচেতা হন। তারা বুঝে-শুনে ভোট দেবেন। সামান্য কোচিং সুবিধা নিয়ে তারা ভোট বিকিয়ে দেবে বলে মনে করি না। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দর্শন ও যোগ্যতা দেখে ভোট দেওয়া উচিত হবে। সূত্র : জাগো নিউজ
আমার বার্তা/এল/এমই