বিএনপি কর্মী হাকিম হত্যায় ৪ সন্দেহভাজন আটক, উদ্ধার সাড়ে ৮ লাখ টাকা
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত বিএনপি কর্মীর গাড়িতে ২২টি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। গাড়িটির সামনের দুটি চাকা গুলিতে ফুটো হয়ে যায়। সামনের কাচে এবং মূল বডিতে চারটি, নিহত আবদুল হাকিমের বাম পাশের জানালার কাচে ১২টি এবং চালকের আসনের পাশের জানালায় করা হয় ৬টি গুলি।
বুধবার (৮ অক্টোবর) দুপুরে মদুনাঘাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সামনে রাখা আবদুল হাকিমের গাড়িতে এসব গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, নিহত আবদুল হাকিমের গাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে কী কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বন্দ্ব থেকেও এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে ধারণা পুলিশের।
ঘটনাস্থলের ২০০ মিটার দূরত্বে মদুনাঘাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দল বেঁধে লোকজন গুলি করা গাড়িটি ঘিরে ধরে দেখছেন। গাড়িটির সামনে এবং দুই পাশে ২২ গুলির চিহ্ন। সামনের দুটি চাকা গুলিতে ফুটো হয়ে গেছে।
এদিকে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চারজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। রাউজানের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আজ দুপুরে তাঁদের আটক করা হয়। তবে এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।
সন্দেহভাজনদের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হাটহাজারী সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজ। তবে আটক ব্যক্তিদের নাম পরিচয় জানানো হয়নি।
তিনি বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁদের আটক করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে আদালতের মাধ্যমে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
>> থমথমে মদুনাঘাট বাজার
প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী ও বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিমের হত্যাকাণ্ডের পর মদুনাঘাট এলাকায় লোকসমাগম কমে গেছে। বাজারের দোকানপাট খুললেও ক্রেতার সংখ্যা তুলনামূলক কম দেখা গেছে।
আজ দুপুরে মদুনাঘাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনাস্থল মদুনাঘাট পানি শোধনাগার প্রকল্পের মূল ফটকের সামনের সড়কের পাশের প্রতিরক্ষা দেয়ালের কিছু অংশ গুলি লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজারের মানুষের সমাগম অন্যদিনের তুলনায় অনেক কম ছিল। ব্যবসায়ীরা গতকালের ঘটনা নিয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হচ্ছেন না। আতঙ্ক কাজ করছে তাঁদের মধ্যে।
ঘটনাস্থলের ঠিক অপর পাশের স্টিলের আলমারির শো রুমের মালিক দিদারুল আলমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, সকাল থেকে কোনো ক্রেতা নেই। গতকাল বিকেলে যখন গুলির ঘটনা ঘটেছিল তখন তিনি পাশের রেস্টুরেন্টে নাশতা করছিলেন। গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে তাঁর দোকানের সামনে এসে তিনি দেখেন তিনজন অস্ত্রধারী হেলমেট পরা যুবক একটি প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে গুলি করছেন। এভাবে কয়েক মিনিটি ১৫ থেকে ২০ বার গুলি করা হয়। পরে হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যান।
দিদারুল আলম বললেন, হামলাকারীরা এবং নিহত ব্যক্তি রাউজানের থেকে মদুনাঘাট সেতু অতিক্রম করে এসেছিলেন বলে এলাকার লোকজন দেখেছে।
আল আমিন নামের পাশের রেস্টুরেন্ট কর্মচারী বলেন, রেস্টুরেন্টের দোতলা থেকে তিনি একের পর এক গুলির শব্দ শুনতে পান। সড়কে তাকিয়ে দেখেন, একটি প্রাইভেট কার ঘিরে গুলি করছেন কয়েকজন যুবক। এই বাজারে আগে তিনি এ রকম ঘটনা কখনো দেখেননি।
এদিকে, গুলিতে নিহত আবদুল হাকিম বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে বিবৃতি দিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আজ সকালে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে রুহুল কবির রিজভী বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীদের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ঘটনায় আবদুল হাকিম নামে এক ব্যক্তি গুলিতে নিহত হন। এই সহিংস ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির একটি বড় ধরনের নজির। এই রক্তাক্ত ঘটনা ওই এলাকার জনমনে উদ্বেগ ও ভীতির সঞ্চার করেছে। বর্তমানে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। চারদিকে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও হতাশা বিরাজমান, যা এই সরকারের কাছ থেকে জনগণ প্রত্যাশা করে না। তিনি বলেন, সহিংস ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে সমাজবিরোধী কিছু দুর্বৃত্ত চক্রের পরিকল্পিত হিংস্র কর্মকাণ্ড। এর সঙ্গে রাজনীতি বা বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে গতকাল মঙ্গলবার রাতে দলটির রাউজানের নেতা-কর্মীরা হাকিম হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক অবরোধ করেন। আজ দুপুরেও নোয়াপাড়া পথেরহাট ও রাউজান সদরের মুন্সির ঘাটায় প্রতিবাদ মিছিল বের করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন। পৃথক দুই স্থানে মিছিল করে হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করা হয়। হাকিম বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ নবায়ন করেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় নেতা–কর্মীরা। এ ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (বহিষ্কৃত) গিয়াস উদ্দিন কাদেরও হাকিমকে নিজের সমর্থক বলে স্বীকার করেছেন।
গতকাল সন্ধ্যায় হাটহাজারীর মদুনাঘাট পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের মাত্র ৬০০ ফুট দূরে মোটরসাইকেলে করে এসে একদল অস্ত্রধারী প্রকাশ্যে গুলি করে মুহাম্মদ আবদুল হাকিমকে হত্যা করে। এ সময় তিনি রাউজানের খামার থেকে চট্টগ্রাম শহরে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ফিরছিলেন। এ ঘটনায় তাঁর সঙ্গে থাকা চালক মুহাম্মদ ইসমাইলও (৩৮) গুলিবিদ্ধ হন।
গুলিবিদ্ধ আবদুল হাকিম রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের পাঁচখাইন গ্রামের বাসিন্দা আলী মদনের ছেলে। তিনি গত ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় হন। নানা অনুষ্ঠানে গিয়াস উদ্দিন কাদেরের সঙ্গে মঞ্চে থাকতেন। তিনি হারবাল ব্যবসার পাশাপাশি গরুর খামারি ছিলেন। এ ছাড়া গত এক বছর ধরে কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলন ব্যবসাও করতেন। রাজনীতিতে তাঁর কোনো দলীয় পদবি ছিল না।
আজ বিকেল পাঁচটায় তাঁর নিজ গ্রাম পাঁচখাইন দরগাহ প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাঁর জানাজা সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে পুলিশ ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। আবদুল হাকিম ১ ছেলে ২ কন্যা সন্তানের বাবা।
গুলিবিদ্ধ আবদুল হাকিমের ভাই মুহাম্মদ পারভেজ বলেন, তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কারও শত্রুতা ছিল না। তিনি গিয়াস উদ্দিন কাদেরর সঙ্গে রাজনীতি করতেন। কী কারণে তাঁকে হত্যা করা হলো তিনি তা তদন্তে করে সন্ত্রাসীদের শাস্তির দাবি করেন।
মদুনাঘাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক কার্তিক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, কী কারণে হাকিমকে হত্যা করা হয়েছে, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তবে রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বন্দ্ব থেকেও এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।
তিনি বলেন, ঘটনাটি ঘটে গেছে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে। গুলির শব্দের পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল কিন্তু মানুষের ভিড়ে হামলাকারীরা মোটরসাইকেলে করে রাউজানের দিকে পালিয়ে যায়। কয়েক মিনিটে এত গুলি কীভাবে করল অস্ত্রধারীরা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুনিরা পেশাদার, অস্ত্রচালনায় পারদর্শী। তাই কম সময়ে এত গুলি করতে পেরেছেন তাঁরা।
উল্লেখ্য, রাউজানে গত ৫ আগস্টের পর সহিংসতায় মোট ১৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। বিএনপির দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয় অন্তত শতাধিকবার। ৩৫০ এর বেশি মানুষ এসব ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন। মামলা হয় অর্ধশতের বেশি। তবে আসামি গ্রেপ্তারের সংখ্যা খুবই কম বলে জানিয়েছেন মামলার বাদীরা।
আমার বার্তা/এমই