রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশে প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হয়নি
প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৫৫ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার খসড়া অধ্যাদেশে প্রকৃত মতামত প্রতিফলিত হয়নি বলে জানিয়েছে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশন। এ কারণে ৭ দফা সুপারিশ করেছে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন।
রোববার (২৬ এপ্রিল) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের এক বিশেষ সাধারণ সভায় (ইজিএম) এসব কথা জানানো হয়। সভায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাকাএভ) নির্বাহী কমিটির প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন।
সভায় গত ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সংগঠনটি বলছে, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের সর্বোচ্চ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ হিসেবে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ১৬৬ কোটি টাকা আহরণ থেকে শুরু করে বার্ষিক গড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ বাস্তবতায় রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব বাস্তবায়ন পৃথককরণে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভিশন ও পরিকল্পনাকে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন ধারণ করে ও স্বাগত জানায়। তবে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে রাজস্ব সংস্কার কেবল পৃথককরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন নয়, বরং তা টেকসই করতে রাজস্ব ব্যবস্থার সামগ্রিক শক্তিশালীকরণ, যথাযথ বিনিয়োগ ও উন্নয়নের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এরই মধ্যে সরকার পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি গঠন করে। বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশন সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সংগঠন দুটি যৌথভাবে তাদের মতামত প্রদান করে। পরে অর্থ উপদেষ্টার আহ্বানে অধ্যাদেশের খসড়া বিষয়ে দুইবার দুই সংগঠনের প্রতিনিধি তাদের মতামত ব্যক্ত করে। গত ১৩ এপ্রিল সংগঠন দুটি যৌথভাবে অর্থ উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপিও দেয়। কিন্তু ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর যে খসড়া প্রকাশিত হয়। সেখানে ওই সংগঠনের মতামত প্রতিফলিত হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
এ অবস্থায় সভায় বেশ কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন। যার মধ্যে রয়েছে–
১) বিসিএস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব নিয়োগের মতামত দিয়েছিল। তবে প্রাপ্ত খসড়ার অনুচ্ছেদ ৪(৩) এ ‘উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব নিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।
এতে রাজস্ব নীতি প্রণয়নে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কারণ রাজস্ব নীতি প্রণয়নে কর রাজস্ব আহরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রাজস্ব নীতি বিভাগের শীর্ষ পদে পদায়ন করা হলে রাজস্ব বিভাগকে পৃথক করার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
২) রাজস্ব নীতি বিভাগের মৌলিক পদগুলো বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডার থেকে পূরণের প্রস্তাব করা হলেও খসড়ার অনুচ্ছেদ ৪(৪) এ আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা, পরিসংখ্যান, প্রশাসন, অডিট, আইন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা থেকে পূরণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন মৌলিক পদগুলোতে বর্তমানে দায়িত্বপালনরত রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের রাজস্ব নীতি বিভাগে সুনির্দিষ্টভাবে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে নীতিনির্ধারণী ও দায়িত্বশীল পর্যায়ে এই দুই ক্যাডারভুক্ত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ প্রতিপাদ্য না হওয়ায় মাঠ অভিজ্ঞতা ও নীতির মধ্যে মারাত্মক ব্যবধান রয়ে যাবে, যা রাজস্ব সংস্কারের মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এছাড়া দীর্ঘদিন মেধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেও নীতিনির্ধারণী পদে কাজের সুনির্দিষ্টভাবে সুযোগ না থাকলে হতাশাজনিত কারণে কর্মস্পৃহা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও প্রেরণার উন্নয়ন ঘটবে, যা সামগ্রিকভাবে রাজস্ব প্রশাসনকে বেগবান করবে।
৩) খসড়ার অনুচ্ছেদ ৯-এ রাজস্ব নীতি বিভাগে জনবল পদায়নে একটি কমিটির কথা উল্লেখ থাকলেও ধারা ৪(৪) এ এমন কোনো কমিটির উল্লেখ নেই। অথচ কমিটি গঠন উল্লেখ করা প্রয়োজন।
৪) খসড়ার অনুচ্ছেদ ৫-এর দফা (চ) এ রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে ‘কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ’ যুক্ত করা হয়েছে। কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিবীক্ষণের বিধান রাখায় নীতি বিভাগকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যক্রম তদারকির সুযোগ থেকে যায়। এক বিভাগের কার্যক্রম সমমর্যাদাসম্পন্ন অন্য বিভাগ কর্তৃক পরিবীক্ষণের বিধান রাখা হলে তা আইনের দৃষ্টিতেও সাংঘর্ষিক বিবেচিত হয়।
৫) খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৩)-এ ‘বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের কর্মকর্তা থেকে রাজস্ব আহরণে ন্যূনতম ২০ বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পালাক্রমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব হিসেবে নিয়োগ প্রদান’র পরিবর্তে ‘রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব/সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান’র বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে কর-রাজস্ব আহরণের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নয় এমন কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকার সৃষ্টি হতে পারে, যা কর-রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত করবে।
৬) খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৫)-এ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদগুলো প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পদস্থ রয়েছেন, যা তাদের নির্ধারিত পদ। কিন্তু খসড়ায় প্রশাসনিক পদগুলোতে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের থেকে পূরণের সুযোগ রাখা হয়নি। বিশেষায়িত দক্ষ জনবল সৃষ্টি, বিদ্যমান জনবলের ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও পেশাগত স্বার্থরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রশাসনিক পদগুলো সংশ্লিষ্ট ক্যাডারভুক্ত জনবল থেকে পূরণ করা বাঞ্ছনীয় বলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
৭) এছাড়া সরকার গঠিত রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর মতো জনসমক্ষে প্রকাশ করা সমীচীন বলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
বিশেষ কোনো মহলের প্ররোচনায় অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের জনআকাঙ্ক্ষা বিরোধী এবং সংস্কারের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশের পরিপন্থি কোনো উদ্যোগ কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির প্রতিবন্ধক হতে পারে বিধায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
আমার বার্তা/এমই