চলতি মাসেই সার উৎপাদনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:১৫ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি মাসেই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, কবে দর ঘোষণা করা হবে সে বিষয়ে কোন দিন-তারিখ চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে সবকিছু গুছিয়ে এনেছি, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যেই আদেশ দিতে চাই।
চলতি মাসে ঘোষণা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হতে পারে। তবে দামের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি বিইআরসি চেয়ারম্যান।
পেট্রোবাংলা এবং গ্যাসের বিতরণ কোম্পানিগুলো সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের বিদ্যমান দর ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করেছে। সেই প্রস্তাবের উপর গণশুনানি গ্রহণ করা হয় অক্টোবর ৬ তারিখে।
গণশুনানি শেষে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেছিলেন, গ্যাসের দাম প্রশ্নে সবদিক বিবেচনা করে ভারসাম্য রক্ষা করা হবে। দাম বেড়ে গেলে সারের উৎপাদন খরচের বিষয়ে আপনারা চিন্তিত! অবশ্যই কৃষিকে বিবেচনায় নিতে হবে। জিডিপিতে কৃষির অবদান কম হলেও খাদ্যের নিরাপত্তা এবং বিশাল কর্মসংস্থানের বিষয়টি অবশ্যই ভাবনার রাখতে হবে। আবার এলএনজি আমদানির খরচের বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে।
পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়, দাম বাড়ানো হলে বাড়তি ৭ কার্গো এলএনজি আমদানি করে সারে সরবরাহ করা হবে। ৬ মাস (অক্টোবর-মার্চ) পুরোমাত্রায় (২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হবে। অবশিষ্ট ৬ মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে ১৬৫ মিলিয়ন হারে, জুনে ১৭৫ মিলিয়ন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৩০ মিলিয়ন হারে গ্যাস সরবরাহ দেবে।
গণশুনানিতে বিসিআইসি পরিচালক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) দেলোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, ২০২২ সালে একইভাবে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়, কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায়নি, বরং অনেকখানি কমেছে সরবরাহ। তবে যদি পুরোমাত্রায় গ্যাস দেওয়া হয় তাহলে ২০ লাখ টনের উপরে সার উৎপাদন করা সম্ভব। আর ২০ লাখ টন সার উৎপাদন করা গেলে গ্যাসের ৩০ টাকা হলেও আমদানির তুলনায় কম দাম পড়বে।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম যদি ৩০ টাকা হয়, আর যদি ২০ লাখ টন উৎপাদন করতে পারি, তাহলে কেজি প্রতি সারের উৎপাদন খরচ পড়বে ৪৬ টাকার মতো। সেখানে আমদানিতে ৬১ টাকার মতো ব্যয় হচ্ছে।
বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩৮ টাকার মতো। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৭ টাকা দরে। আর বিসিআইসি ডিলারদের কাছে বিক্রি করছে ২৫ টাকা দরে। এতে ট্রেড গ্যাপ কেজিতে ১৩ টাকা ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে। গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে ট্রেড গ্যাপ বেড়ে যাবে। ট্রেড গ্যাপের সুরাহা না করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সার কারখানাগুলো তীব্র আর্থিক সংকটে পড়বে। গ্যাস বিল পরিশোধে বিলম্বসহ সারের উৎপাদন হুমকির মুখে পড়তে পারে দাবি করেছে বিসিআইসি।
শুনানিতে বিসিইআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে গ্যাসের মিশ্রিত দর পড়ছে ২৮ টাকার মতো। অন্য যেকোন ক্ষেত্রের তুলনায় কৃষিতে দাম কম হওয়া উচিত। কারণ এরসঙ্গে খাদ্যের উৎপাদন জড়িত।
ভোক্তাদের পক্ষ থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর তীব্র বিরোধীতা করা হয়। বক্তারা বলেছেন, এতে সারের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর সারের দাম বেড়ে গেলে কৃষির উপর চাপ বাড়বে। তাদের উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। আর দাম বাড়ালে স্ল্যাব পদ্ধতির প্রস্তাব করেন একজন ভোক্তা।
তিনি বলেন, গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য স্ল্যাব করা যেতে পারে। বেশি গ্যাস সরবরাহ হলে বেশি দাম পাবে। না হলে ২০২২ সালের মতো শুধু শুধুই দাম বাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
বিসিআইসির রিপোর্ট বলেছে, আগের সরবরাহ বাড়নোর কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধুমাত্র ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পিএলসি প্রায় পুরোমাত্রায় উৎপাদন করেছে। যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি গ্যাসের অভাবে ৩৬১ দিন, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি ২৭৩ দিন, ঘোড়াশাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি ১৯৮ দিন বন্ধ ছিল। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি মাত্র ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ সময় উৎপাদনে ছিল।
ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পিএলসির দৈনিক চাহিদা ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের চাহিদা ৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট, যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪১ মিলিয়ন ঘনফুট, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের চাহিদা ৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত আশুগঞ্জ সার কারখানা অনেক পুরোনো হওয়ায় গ্যাস খরচ অনেক বেশি, যে কারণে কারখানাটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন কাফকো সারকারখানায় দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট। কাফকোকে চুক্তির আওতায় নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আর তাদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক দরে ডলারে সার কিনে নেয় বাংলাদেশ। সম্প্রতি কোম্পানিটির সঙ্গে ৩০ টাকা দরে চুক্তির নবায়ন করা হয়েছে।
বিসিআইসির তথ্য অনুযায়ী, বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন ইউরিয়া সার যোগান দিতে হয়। গ্যাসের অভাবে আমদানি করে ১৬ থেকে ২১ লাখ টন যোগান দিতে হয়। গ্যাস অভাবে বন্ধ থাকায় কারখানাগুলো কুলিং টাওয়ার, ইলেকট্রিক্যাল বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যে কারণে পরিচালনা খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
আমার বার্তা/এল/এমই