বাংলাদেশে আসছে ‘ওপেন ব্যাংকিং’ ব্যবস্থা
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৫০ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো গ্রাহকের একটি ব্যাংকে হিসাব থাকলেও তিনি তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেনদেনের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে অন্য ব্যাংকের সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।
আর্থিক খাতে আরও স্বচ্ছতা ও উদ্ভাবন নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে বাংলাদেশেও চালু হতে যাচ্ছে 'ওপেন ব্যাংকিং' ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো গ্রাহক একটি ব্যাংকে হিসাব থাকলেও তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তার লেনদেনের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে অন্য ব্যাংকের সেবাও গ্রহণ করতে পারবেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি কোনো গ্রাহকের সিটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে, তবে সেই ব্যাংকের লেনদেনের পারফরম্যান্স বা কার্যক্রমের ভিত্তিতে তিনি ইস্টার্ন ব্যাংক থেকেও ভিন্ন ধরনের সেবা নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে ইস্টার্ন ব্যাংক গ্রাহকের পারফরম্যান্স–সংক্রান্ত তথ্য তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করবে।
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাহকরা নিজেদের সম্মতিতে তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক বা অ্যাপের মাধ্যমে আর্থিক তথ্য শেয়ার করতে পারবেন। এতে ঋণ গ্রহণ, বিল পরিশোধ, ব্যয় বিশ্লেষণ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য একই প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, এই পদ্ধতি গ্রাহকদের জন্য আর্থিক সেবা গ্রহণ আরও সহজ করবে এবং আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে গভীর ধারণা দেবে। এর ফলে সেবার মান উন্নত হবে, খরচ কমবে এবং রিয়েল-টাইম ডেটার মাধ্যমে দ্রুত ঋণ অনুমোদন ও ব্যক্তিগত আর্থিক সমাধান দেওয়া সম্ভব হবে।
গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম বাংলাদেশ ফিনটেক সামিটে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের পরিচালক শরাফত উল্লাহ খান বলেন, "ব্যাংক, ফিনটেক প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় খুব শিগগিরই বাংলাদেশে 'ওপেন ব্যাংকিং' ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "বেসরকারি ক্রেডিট ব্যুরো, পেমেন্ট ইনিশিয়েশন সার্ভিস এবং ডিজিটাল ব্যাংকের বিকাশে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।"
'ওপেন ব্যাংকিং: রিডিফাইনিং ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ফর দ্য নেক্সট ডিকেড' শীর্ষক আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে মাস্টারকার্ড ও প্রাইম ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে 'ওপেন ব্যাংকিং গাইডলাইন' ও মানসম্মত অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) প্রোটোকল প্রকাশের পরিকল্পনা করছে। এ লক্ষ্যে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে, যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দিকনির্দেশনা দেবে।
লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তিনি বলেন, "ওপেন ব্যাংকিং চালু হলে ব্যাংকগুলো তৃতীয় পক্ষের ফিনটেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে গ্রাহকসেবা উন্নত করতে পারবে। আমরা যদি সঠিক চ্যানেল তৈরি ও কর্মীদের প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ বাড়াতে পারি, তাহলে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানো সম্ভব।"
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় ওপেন ব্যাংকিং ইতোমধ্যে নিয়মিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছে। সেখানে গ্রাহক নিজের তথ্য ব্যবহারের পূর্ণ অধিকার রাখেন এবং বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য একত্র করে এক প্ল্যাটফর্মে তা ব্যবহার করতে পারেন।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে গ্রাহকের সম্মতি, সাইবার নিরাপত্তা এবং তথ্য সুরক্ষা আইন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।"
"ওপেন প্ল্যাটফর্ম চালু হলে নতুন ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবনী আর্থিক সমাধান আনতে পারবে এবং ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতায় আরও সক্ষম হবে," যোগ করেন তিনি।
গ্লোবাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড টেকনোলজি নেটওয়ার্কের (জিএফটিএন) সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী সপ্নেন্দু মোহান্তি বলেন, 'ওপেন ব্যাংকিং'–এ 'ওপেন' শব্দটি অনেক সময় স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করে, কারণ বিভিন্ন দেশ এটি ভিন্ন ভিন্ন মডেলে গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য প্রতিযোগিতা বাড়াতে সাধারণ এপিআই–এর মাধ্যমে তথ্য উন্মুক্ত রাখাকে বাধ্যতামূলক করেছে; ভারত আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করতে সরকার-সমর্থিত অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিগেটর মডেল ব্যবহার করছে; আর সিঙ্গাপুর গ্রহণ করেছে হাইব্রিড, উদ্ভাবননির্ভর ও বাজারচালিত একটি পদ্ধতি—যা তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ন্যায়সঙ্গত ও সমতাভিত্তিক ডেটা শেয়ারের নীতিতে পরিচালিত।
ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে ওপেন ব্যাংকিং
সিঙ্গাপুরে 'ওপেন ব্যাংকিং' চালু হয়েছে মোনেটারি অথরিটি অব সিঙ্গাপুর (এমএএস)–এর তত্ত্বাবধানে। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক ও ফিনটেক কোম্পানির মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এমএএস 'এপিআই এক্সচেঞ্জ (এপিআইএক্স)' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে, যেখানে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপদে গ্রাহকের তথ্য শেয়ার করতে পারে।
দেশটির ওপেন ব্যাংকিং কাঠামোতে স্ট্যান্ডার্ডাইজড এপিআই পলিসি অনুসরণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। সিঙ্গাপুরের এই মডেলটি সরকার–নিয়ন্ত্রিত হলেও ইনোভেশন–সহায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
ভারতে ওপেন ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালিত হয় রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)–অনুমোদিত অ্যাকাউন্ট অ্যাগ্রিগেটর (এএ) ফ্রেমওয়ার্কের আওতায়। এই কাঠামোর মাধ্যমে গ্রাহকের সম্মতিতে অনুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো—যেমন ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্স কোম্পানি (এনবিএফসি) ও বিমা প্রতিষ্ঠান—ডেটা শেয়ারিং ও অ্যাক্সেস করতে পারে।
এই উদ্যোগ ভারতের ডিজিটাল অবকাঠামো ইন্ডিয়া স্ট্যাক–এর অংশ, যা দ্রুত ঋণ মূল্যায়ন, ডিজিটাল লেনদেন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভারতের ওপেন ব্যাংকিং মডেলটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও নিয়মভিত্তিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংক, পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি), পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও) এবং ই-মানি ইস্যু সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ ভবিষ্যতে 'ওপেন ব্যাংকিং' বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করবে। ইতোমধ্যেই ইন্টারঅপারেবল ডিজিটাল ট্রানজাকশন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) ও বাংলা কিউআর ব্যাংক ও ফিনটেকের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, 'ওপেন ব্যাংকিং' চালু হলে গ্রাহকরা একক অ্যাপের মাধ্যমে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, পেমেন্ট ও বিনিয়োগ সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এতে গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে, পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
আমার বার্তা/এল/এমই
