গুমে রাজি না হওয়া কর্মকর্তাদের তথ্যও যেত শেখ হাসিনার কাছে
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১২:১৯ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

গুম–খুনে জড়াতে কিছু কর্মকর্তা অস্বীকৃতি জানিয়ে তা লিখিতভাবে জানানোর তথ্য পেয়েছে গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। এসব চিঠি সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদনে।
সোমবার (২৪ জুন) প্রকাশিত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এমন একটি ঘটনার উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে।
এক ঘটনায় দেখা যায়, র্যাবের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন আটক এক বন্দীকে হত্যা করতে বলা হয়। কারণ, অসতর্কতায় বন্দীর অবস্থান ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তবে তিনি বেআইনি এই নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, ‘যদি ওনাকে মারতে হয়, তাহলে আমাকে সরিয়ে দিন, আমি মারব না।’ শেষ পর্যন্ত বন্দীকে হত্যা করা হয়নি এবং ওই কর্মকর্তা ৫ আগস্টের পরও চাকরিতে বহাল ছিলেন।
তদন্ত কমিশন বলছে, এ ঘটনা পুরোপুরি কাকতালীয়ভাবে উন্মোচিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক সদস্য ৫ আগস্টের পর গণভবনে পরিত্যক্ত কিছু নথি ঘেঁটে র্যাব কর্মকর্তাদের হাতে লেখা দুটি চিঠি আবিষ্কার করেন। এতে তারা বেআইনি আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং এসব চিঠি গোয়েন্দা শাখার পরিচালক বরাবর লিখলেও সেগুলো সরাসরি শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তিনি ২০১৫ সাল থেকে ভারত পালানোর আগপর্যন্ত এসব নথি নিজের কাছে রেখেছিলেন।
এক চিঠিতে লেখা ছিল, ‘যদি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুলি চালানোর পরিকল্পনা থাকে, তাহলে আমি সে অভিযানে অংশ নেব না।’ কমিশন বলছে, এসব ‘ব্যক্তিগত ঘোষণাপত্র’ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানের ব্যাপ্তি এবং সংবেদনশীল নথিপত্র দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের রাজনৈতিক গুরুত্ব বোঝায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৫ আগস্টের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার বক্তব্যে জানা যায়, ওই দুই কর্মকর্তা একটি মিলিটারি পুলিশ চেকপোস্টে আশ্রয় নিয়ে পরে সেনাবাহিনীতে ফিরে যান। অথচ আদেশ অমান্য করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি—যা ওই সময়কার রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বাস্তবতায় ব্যতিক্রম।
রাজনৈতিক নির্দেশনাই মূল
দন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিএফআইয়ের একাধিক সাবেক কর্মকর্তা যেমন লে. জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন স্বীকার করেছেন, গুম সংক্রান্ত বিষয়ের আলোচনা সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে হতো। উদাহরণস্বরূপ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদেরকে নিয়ে আলোচনা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গিয়েছিল।
ডিজিএফআইয়ের এক কনিষ্ঠ কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, তিনি নিজের পরিচালকের মুখে শুনেছেন, শেখ হাসিনা একজন বন্দীর বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং মতও দিয়েছেন। এসব থেকে প্রতীয়মান হয়, গুমের মতো ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছিল।
কমিশনের ভাষায়, ডিজিএফআই ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তখন বেসামরিক নেতৃত্ব ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে ‘সংযোগকারী’ হিসেবে কাজ করতেন। ফলে গুমের ঘটনাগুলো বাহিনীগুলোর নিজস্ব কর্মকাণ্ড ছিল না, বরং রাজনৈতিক আদেশ বাস্তবায়ন ছিল।
আওয়ামী লীগ দায় চাপাচ্ছে বাহিনীর ওপর
দীর্ঘদিন ধরে গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে আসলেও, শেখ হাসিনার ভারত পালানোর পর আওয়ামী লীগের অবস্থান নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। ১৬ এপ্রিল আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত দাবি করেন, তাদের আমলে যেসব গুম হয়েছে, তা বাহিনীর ‘নিজস্ব উদ্যোগে’ হয়েছে—না কি সরকারের নির্দেশে।
তদন্ত কমিশন বলছে, বর্তমান বয়ানে সরকার নিজেকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করছে এবং পুরো দায় সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় এড়ানোর কৌশল মাত্র।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন এমন ব্যক্তিরাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, যাঁরা আগে গুমে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তবে বর্তমানে বৈধ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা ব্যক্তিদের পলায়নে সহায়তা করে তারা দ্বিতীয় স্তরের অপরাধে যুক্ত হচ্ছেন।
গোপন নজরদারি ও পেশাগত হয়রানি
গুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত সাত কর্মকর্তার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে কমিশন। তদন্তে দেখা গেছে, এসব ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যরা সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এসব অপরাধ একক বা বিচ্ছিন্ন ছিল না। নথিপত্রে তাদের আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয়, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ‘গুম’ শব্দটি কোথাও লেখা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম বা অন্যায় আদেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলা কর্মকর্তাদের পেশাগতভাবে হেয় করা হয়েছে। একজন কর্মকর্তা জানান, তিনি গুমের বিরোধিতা করায় বারবার নতুন কর্মস্থলে সহকর্মীদের ‘সতর্ক করা’ হতো তাকে বিশ্বাস না করতে। এমনকি তার পরিবারের ওপরও নজরদারি চলত। শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করলেও তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ তদন্ত, নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়—যা তাকে পেশাগতভাবে কোণঠাসা করে দেয়।
আমার বার্তা/জেএইচ