ভূমি-বণ্টনে বৈষম্য ও নেতৃত্বের অভাবেই পাহাড়ে অস্থিরতা
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:৩২ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন:

পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান অস্থিরতা ও জাতিগত বিভাজনের পেছনে ভূমি-বণ্টনে বৈষম্য, নেতৃত্বের অভাব, গুজব ও বহির্বিশ্বীয় প্রভাবকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বক্তারা। তারা বলছেন, শান্তিচুক্তির সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা দূর করে সময়োপযোগী পুনর্মূল্যায়ন, সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমবণ্টন ও স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
বুধবার (৮ অক্টোবর) দুপুরে রাওয়া হলে এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনা সভায় সিএইচটি সম্প্রীতি জোটের প্রধান সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার থোয়াই চিং মং শাক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বললেই মনে করি, চাকমা। শান্তু লারমার একটা বাহিনী ছিল— জেএসএস। সেই জেএসএস থেকে আজ সাতটা দল তৈরি হয়েছে। এই দলগুলো তৈরির পেছনে কারণ কী? আমরা রাঙ্গামাটিকে লিজ দিয়েছি চাকমাদের হাতে, বান্দরবানকে লিজ দিয়েছি মারমাদের হাতে, আর খাগড়াছড়িকে লিজ দিয়েছি ত্রিপুরাদের হাতে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারিনি, তার একমাত্র কারণ এই তিনটি জাতির কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম লিজ দেওয়া আছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, নয়তো পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র হতেই থাকবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী, নৃগোষ্ঠী, সেটেলার, সেটেলার বাঙালি শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। আপনারা ঢাকায় বসে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন— 'পাহাড়ি বাঙালি' বলেন, মানে কি? আপনিও পাহাড়ি, আমিও পাহাড়ি, যে পাহাড়ে বসবাস করে তারাই পাহাড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিরসনে সবার মধ্যে সমবণ্টন করতে হবে। পাহাড়ে ভূমিহীনদের ভূমির ব্যবস্থা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা-কেন্দ্রিক স্বপ্ন না দেখে সমস্ত জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তবেই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বা পশ্চিমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে বাংলাদেশ আর্মির উল্লেখ করে অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন বলেন, আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সাত বছর ফ্লাইং করেছি। তখন আমি দেখেছি বাংলাদেশ আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে কত প্রাণ দিয়েছে, সে কারণে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অংশ হিসেবে রয়েছে। অনেকেই অনেক কথা বলবেন— আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চাই, আর্মির উপস্থিতি চাই না, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম স্পেশাল প্লেস। এখানে আর্মির কারণেই সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা এখনো বজায় রয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা তখন ৪০০ ক্যাম্পে ফ্লাইং করেছি। সেই ক্যাম্পের সংখ্যা কোথায় নেমে এসেছে! আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ১৯৮০ সাল অথবা ১৯৯০ এর দিকে যে ব্যবস্থাপনা ছিল, যে অর্ডারটা আমাদের এস্টাবলিশ করতে হবে। নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে তাদেরকে বোঝাতে হবে। তাহলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আর কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের যে বাঙালিরা আছে, তাদের মধ্যেও তেমন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। সেটা গড়ে তুলতে হবে। সম্প্রতি যে ঘটনাটা ঘটেছে, একই ঘটনা ২০১৭ সালেও ঘটেছিল। তখনও কিন্তু এক গুজবের ওপরে বহু মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই গুজবটা কারা ছড়ায় আমরা কিন্তু জানি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ইন্ধনে সেখানে ইউপিডিএফসহ যে সশস্ত্র বাহিনীগুলো আছে, তারা এই গুজবগুলো ছড়ায়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে গুজব ছড়ানোর যে তাদের মিডিয়া, সেটি খুব শক্ত। পত্রিকায় হেডলাইন হচ্ছে ১৪৪ ধারা উঠে গেছে, পাহাড়িরা আতঙ্কে। আতঙ্কে হচ্ছে তাদের জিনিসপত্র, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে কি বাঙালিরা নেই?
সাবেক এই বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ে কোনো সমস্যা হলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা একপেশে বিবৃতি বা মন্তব্য করেন। তারা নিজেরা না বুঝে, না জেনে যে বিবৃতি দেওয়া শুরু করে, তাতে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়। বুদ্ধিজীবীদের একপেশে বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শান্তি চুক্তির সবগুলো ধারা যদি কার্যকর হতো, তাহলে পাহাড়ের সমস্যা অনেক কমে যেত। শান্তি চুক্তির এই ধারায় সমস্যা রয়েছে, সাংবিধানিক সাংঘর্ষিকতাও রয়েছে। আমি মনে করি, শান্তি চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন বা পুনর্বিবেচনা একান্তই প্রয়োজন। এটা পুনর্মূল্যায়ন না করা গেলে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।
আলোচনা সভায় রাওয়া চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) আবদুল হক বলেন,দুর্গম পার্বত্য এরিয়ায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে, অনেকে আহত-নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪০০ জনের মতো শহীদ হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য।
আলোচনা সভায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, পাহাড়িদের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। পাহাড়ে গুজব ছড়ায় ইউপিডিএফ এবং পার্শ্ববর্তী দেশ। গণমাধ্যমে একপেশে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। পাহাড়ে কিছু হলে না বুঝে না জেনে একদল বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিতে শুরু করেন। শান্তি চুক্তি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এটা পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। এই সমস্যার সঙ্গে দেশের সবার একত্রিত হতে হবে।
চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাহফুজ পারভেজ বলেন, প্রকৃত সত্য যে, আমরা বাঙালিরা, যারা ওখানে আছি, তাদের মধ্যেও সেরকম কোনো নেতৃত্ব এখনো পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। এই নেতৃত্বটা গড়ে উঠতে হবে। এই যে ঘটনা রিসেন্টলি ঘটল, এই ঘটনা একই, একদম হুবহু একই ঘটনা, ২০১৭ সালে আমি ডিসি থাকার সময়েও ঘটেছিল। তখনও কিন্তু এক গুজবের ওপরেই বহুত ভাঙচুর, বহু মারামারি হয়েছে।
তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির সবগুলো ধারা যদি ইমপ্লিমেন্টেবল হতো, তাহলে এ পর্যন্ত এটা ইমপ্লিমেন্ট হয়ে যেত। এই ধারায় সমস্যা আছে। এটার সঙ্গে সংবিধানের সাংঘর্ষিক ধারা আছে। সুতরাং, এটা ইমপ্লিমেন্টেবল কিনা, সেটা প্রশ্ন উঠতেই পারে।
সভায় আমার দেশ সংবাদপত্রের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, শান্তি বাহিনী ১৯৭৬ সালের আগে বাংলাদেশে কোনো আগ্রাসন চালায়নি। ফলে মনে হচ্ছে ভারত একটি অস্ত্র হাতে রেখেছে, যেটি সময়-সুযোগমতো ব্যবহার করছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। যে সময়ে ভারতের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় থাকবে না, তখন তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করবে।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর প্রকৃত ইতিহাস যদি দেখি, ১৯৭১ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ৫৪ বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে সেনাবাহিনী বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনী সেটি গোপন রাখে। প্রকাশ না করার পেছনে কারণ থাকতে পারে, সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি। কিন্তু এখন এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আমার বার্তা/এমই