বিমানবন্দরে আগুনে ছাই কোটি টাকার শিপমেন্ট, ক্ষতির ভারে কাতর ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:০৪ | অনলাইন সংস্করণ

  আমার বার্তা অনলাইন

রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোটি টাকার গার্মেন্টস পণ্য, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের শিপমেন্ট পুড়ে গেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে শুধু তাদের আর্থিক হয়েছে এমন নয়, গুরুত্বপূর্ণ অন্যের অনেক চালান পুড়ে গিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যাওয়া সহ এর প্রভাব মাঠ পর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ব্যাপক হারে পড়বে। বিশেষ করে ওষুধ শিল্পের প্রচুর পরিমাণ কাঁচামাল আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ‌যা শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, এসব কাঁচামাল দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করতেন।

আবার গঠনস্থলে উপস্থিত অনেকেই বলছেন, আগুন নেভানোর কাজে গাফিলতি ছিল। শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে যেতে পারে নাই। ২০ থেকে ২৫ মিনিট কালক্ষেপণ হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে এর মধ্যে আগুন সারা ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

রোববার (১৯ অক্টোবর) সকাল ১১টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। ‌

সরেজমিনে দেখা যায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও কারগো ভিলেজের ভবনে এখনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের বাইশটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এখনও কাজ করছে। ‌ আর আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ দেখতে উপস্থিত হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা, উৎসুক জনতা এবং বিভিন্ন সংস্থার লোকজন।

তাদের মধ্যে একজন ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরায় গার্মেন্টস প্রোডাক্ট ইনপুট করা প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট অ্যান্ড সেফের মালিক মো. বেনজির বলেন, হংকং ও চায়না থেকে আমার দুইটি শিপমেন্ট এসেছিল রেডিমেড গার্মেন্টসের। এগুলো সব পুড়ে গেছে। স্যাম্পল প্রোডাক্টও ছিল। আমরা ছোট ব্যবসায়ী, আমাদের লাখ পাঁচেক মালামাল পুড়লেও এটা আমাদের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ। আজ আমার মালামাল গুলো খালাস করার কথা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, গতকাল আগুনে সব পুড়ে ছাই!”

এদিকে এক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় ধরে ফায়ার সার্ভিস বিমানবন্দরের আট নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, গেটও বন্ধ ছিল। এর কারণ তারা জানেন না।

এ বিষয়ে ঘটনার সময়ের বর্ণনা দিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের ‘কিউইপি-এক্সপ্রেস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. সাইদ হোসেন বলেন, দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে কার্গো ভিলেজের আমদানি কারো কমপ্লেক্সের কেমিক্যাল গোডাউনের প্রথম আগুন দেখতে পাই। ‌তারপর কিছুক্ষণ পরে দেখি ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি গাড়ি আসে। কিন্তু গাড়িগুলো ৮ নম্বর গেট দিয়ে প্রবেশ করতে পারছিল না। ‌কি কারণে জানি গাড়িগুলো ১৫ থেকে ২৫ মিনিট দাঁড়িয়েছিল। শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিনে মালামাল খালাস বন্ধ থাকে। ভিতরে প্রচুর পরিমাণে কেমিক্যাল, গার্মেন্টস পণ্য ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে ৪৫টি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস তাদের অপারেশন চালায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালামাল আসে। এখন তো মনে হচ্ছে সব পুড়ে গেছে।

হবে সব থেকে বেশি আশঙ্কা ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পড়ে যাওয়ার। এর শুধু আর্থিক ক্ষতি নয় স্বাস্থ্য খাতে এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। জীবনরক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ অনেক ওষুধের কাঁচামালি গতকালের ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গিয়েছে।

প্রায় ১ লাখ ডলারের ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত এম/এস এজ জি এস কোম্পানি নামে সিএনএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানটি। দেশের নামিদামি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল এনে খালাস ও সরবরাহের কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটির কাস্টম সরকার মাহাতাব উদ্দিন ঘটনাস্থলে বলেন, দেশের যত নামিদামি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আছে, তাদের জন্য আমরা কাঁচামাল আনি চায়না, ভারত ও জার্মানি থেকে। এই তিন দেশ থেকে আসা ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের ২০টি শিপমেন্ট ভিতরে ছিল। আজকে থেকে এসব মালামাল খালাস করে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর গোডাউনে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। 

তিনি বলেন,এখন যেসব তথ্য পেয়েছি এবং আশঙ্কা করছি সব পুড়ে ছায়। ২০টি শিপমেন্টে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার কেজি কাঁচামাল ছিল, যার অর্ডার আনুমানিক মূল্য প্রায় এক লাখ মার্কিন ডলার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এসব কাঁচামাল দিয়ে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি করা হতো।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া যত প্রকার ওষুধ তৈরি হয় দেশে, যেসব ওষুধের কাঁচামাল ছিল, এখন এটার একটা ব্যাপক প্রভাব পড়বে ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে এবং মাঠ পর্যায়ে। মাল খালাস না করতে পারায় এবং আগুনে পুড়ে যাওয়ায় আমাদের কোম্পানিরও বিশাল অংকের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর যে সব ওষুধ প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান মালামাল নিয়ে আসে, তাদের মালামাল যদি এভাবে পুড়ে যায়, তাহলে তো আমরা ব্যবসা পাব না। দিন শেষ—আমাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি, তাদের তো আরো বেশি ক্ষতি।

সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে– যারা গার্মেন্টসের কাঁচামাল রপ্তানি করেছে। যেহেতু দেশের গার্মেন্টস শিল্পের ব্যাপকতা অনেক, তাই গার্মেন্টসের কাঁচামাল আসতো বেশিরভাগ বিমানবন্দর দিয়ে। তাই পোষাক কারখানার সম্পর্কিত কাঁচামাল বেশি পুড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পিটি গ্রুপের এজিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দশটি শিপমেন্ট ছিল কার্গো ভিলেজে। এসব শিপমেন্টে ছিল দেশের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানার জন্য আনা গার্মেন্টসের কাঁচামাল। এর মধ্যে বেশি ছিল– ফেব্রিক্স ও সুতা। এছাড়া ডাইং মেশিনের জন্য অ্যাক্সেসরিজ, স্পেয়ার পার্টস ছিল এবং বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের প্রায় ১৫০টির মতো স্যাম্পল কুরিয়ার ছিল, যেগুলো বায়াররা আমাদেরকে পাঠিয়েছে।

তিনি বলেন, এই ১০ শিপমেন্টে চার থেকে পাঁচ টন কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ ছিল। বর্তমান বাজার মূল্য ৯ থেকে ১০ কোটি টাকা। আমাদের দশটি শিপমেন্টে চায়না থেকে সুতা ও ফেব্রিক্স এসেছে, ভারত থেকে সুতা এসেছে এবং জার্মানি থেকে ডাইং মেশিনের যন্ত্রাংশ এসেছে। বেনাপোল বন্দর বন্ধ থাকায় ভারতীয় সুতা আমাদেরকে এখন ফ্লাইটের মাধ্যমে নিয়ে আসতে হয়। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে– এখনও যেসব ফ্লাইট শিপমেন্ট নিয়ে চলে এসেছে এবং আসবে, সেসব মালামাল রাখার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করা উচিত। না হয়, প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাদের ক্ষতি হবে লাখ লাখ টাকা।

তিনি আরও যোগ করেন, এখানে আমাদের সব শিপমেন্টের উপরই ইন্সুরেন্স করা আছে। আমরা ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ টাকাটাই ক্লেম করবো—এখন দেখা যাক বাকিটা কী হয়। তবে যে পরিমাণ কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ পুড়ে গিয়েছে, এর প্রভাব আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে দীর্ঘদিন থাকবে। ইতোমধ্যে এর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে, আমরা বিভিন্নভাবে তথ্য পেয়েছি। কাঁচামাল ছাড়া তো আর প্রোডাক্ট তৈরি করা সম্ভব না। আজকে থেকে মালামাল গুলো আমাদের খালাস করার কথা ছিল পর্যায়ক্রমে।

কার্গো ভিলেজে লাগা এই আগুনে দেশের গার্মেন্টস ও ওষুধ শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, লাখ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে গেছে—এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

এর আগে শনিবার দুপুর সোয়া ২টায় বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট। একইসঙ্গে কাজ করেন নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সিভিল অ্যাভিয়েশন, দুই প্লাটুন বিজিবিসহ পুলিশ-আনসার সদস্যরা।

সূত্র বলছে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজটি মূলত পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি জায়গায় যা আট নম্বর গেটের পাশে ছিল। আর আগুন লেগেছে আমদানির কার্গো কমপ্লেক্স ভবনে। এখানে আমদানি করা পণ্য রাখা হয়। আগুনে এখানকার প্রায় সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানা যায়।


আমার বার্তা/জেএইচ