১৭ কোটি মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার হাসপাতাল, এর সক্ষমতাও দুর্বল
স্বাস্থ্যসচিবের অকপট স্বীকারোক্তি
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১৬ | অনলাইন সংস্করণ
আমার বার্তা অনলাইন

১৭ কোটি মানুষের দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য কার্যত একটিমাত্র হাসপাতাল এবং সেটিরও পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসা, স্ক্রিনিং ও পরবর্তী যত্ন—সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ভয়াবহ ঘাটতির মধ্যে আছে। রোগীরা ভর্তি হতে না পেরে লাইনে দাঁড়ায়, কেউ কেউ রাস্তায় শুয়ে থাকে।
রোববার (২৭ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ‘স্তন ক্যান্সার সচেতনতা মাস’ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে স্বাস্থ্যসচিব এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ১৭ কোটি মানুষের জন্য ক্যান্সার চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে কার্যত একটিই হাসপাতাল রয়েছে। এতে রোগীরা ভর্তি হতে না পেরে লাইনে দাঁড়ায়, কেউ কেউ রাস্তায় শুয়ে থাকে।
সচিব আরও বলেন, আমাদের দেশে ক্যান্সারে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। এর অন্যতম কারণ হলো লেট স্ক্রিনিং। শেষ সময়ে এসে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ায় ট্রিটমেন্টও লেটে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী এমন এক সময়ে আসে, যখন আর কিছু করার থাকে না। যার ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় অনিবার্য মৃত্যুতে।
তিনি বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক প্রস্তুতি দুর্বল এবং এই সেবা প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ক্যান্সার চিকিৎসার পুরো কাঠামোটিই হাসপাতাল ভিত্তিক প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। এর ফলে, যার যেখানেই সমস্যা হোক না কেন, ক্যান্সার হলেই সবাই মহাখালীর সেই একটি হাসপাতালে চলে আসে।
সচিব বলেন, সমন্বয়ের অভাবের কারণেই অনেক রোগী ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পেয়ে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। গ্রামে থেকে আসা রোগীরা কষ্ট করে আসে এবং ভর্তি হতে না পেরে রাস্তায় শুয়ে থাকে। অনেক সময় তাদের জন্য ‘তদবির’ (বিশেষ অনুরোধ) করতে হয়।
নিজের পরিবারের উদাহরণ টেনে সচিব বলেন, এই ব্যাধিটি আমার পরিবারেও আঘাত হেনেছে। আমার বড় বোন ক্যান্সারে মারা গেছেন, আমার শাশুড়িও ক্যান্সারের রোগী এবং আত্মীয় গত মাসেই মারা গেছেন।
তিনি আরও বলেন, পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে মনে করা হয় এটি নিয়ে কাজ করা দরকার। এর বাইরে আসলে আমাদের মনোযোগ বা অ্যাটেনশন কম থাকে। তবে আমি মনে করি, যে কোনো সুস্থ মানুষ যে কোনো সময় ক্যান্সারের তালিকায় যোগ হতে পারে।
সাইদুর রহমান বলেন, সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, কিন্তু শুধু ক্যান্সার হাসপাতাল করে কোনো লাভ হবে না। অনেক মানুষ ভালো ক্যান্সার সার্জনকে কোথায় পাওয়া যাবে বা কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যাবে, সেই জায়গাগুলো সম্পর্কেও জানে না, যা খুবই উদ্বেগজনক।
তিনি স্ক্রিনিং সক্ষমতার অভাবের দিকটি বিশেষভাবে তুলে ধরে বলেন, আমরা সচেতন হলাম, কিন্তু স্ক্রিনিং করার কোনো জায়গা নেই। তাই সেই সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে।
চিকিৎসার মান নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে সচিব বলেন, ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দুর্বলতা ও দীনতা আছে। সরকারি বা বেসরকারিভাবে রাতারাতি এই দীনতা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল এবং আমাদের আসলে সেই সক্ষমতা নাই।
মৃত্যুকালীন যত্ন ও প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অভাব প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য সচিব বলেন, ক্যান্সার হওয়ার পরের সময়টা—অর্থাৎ রোগ পরবর্তী কেয়ার বা মৃত্যুকালীন প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও আমাদের কোনো ব্যবস্থা নেই। মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে রোগীরা যাতে একটু কম যন্ত্রণায় মারা যেতে পারেন, সেই ধরনের ‘প্রিপারেশন’ বা প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রস্তুতিও দেশে দুর্বল।
তিনি বলেন, এই কষ্ট থেকে কীভাবে বের হওয়া যাবে জানি না, তবে মারাত্মক এই ব্যাধি মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে চেষ্টা করতে হবে। পরিবারের অভিজ্ঞতা আমাকে বুঝিয়েছে, ক্যান্সার শুধু একটি রোগ নয়—এটি আমাদের মানবিকতা ও প্রস্তুতিরও পরীক্ষা।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা নিজেই যখন বলেন, রোগী রাস্তায়, হাসপাতাল একটিই—তখন স্পষ্ট হয়, ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখনো মৌলিক সক্ষমতার দিক থেকেও অপ্রস্তুত। সচিবের এই অকপট স্বীকারোক্তি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি এক বাস্তব মানবিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
আমার বার্তা/জেএইচ
