শ্রমিক দিবস ও বাংলাদেশের শ্রমজীবী সমাজ
প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ
খন্দকার আপন হোসাইন:
উৎপাদনের জীবন্ত উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয় শ্রম। সাধারণ দৃষ্টিতে শ্রম মানে শারীরিক পরিশ্রম। অর্থনীতিতে শ্রম বলতে অর্থোপার্জনের জন্য উৎপাদন ক্ষেত্রে মানুষের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমকে বুঝায়। অধ্যাপক জেরোমি লি নিকোলসন এর মতে "শিক্ষা, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, বিচার-প্রশাসনসহ সরকারের সকল শাখায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের পেশাগত দক্ষতাকে শ্রম বলে।" শ্রম এবং শ্রমিক শব্দ দুটি ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। কারণ শ্রমের সৃষ্টিকর্তা শ্রমিক। শ্রমিকশ্রেণি আবার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। কেউ উচ্চবর্গীয় শ্রমিক কেউ দিনমজুর। শ্রমিকশ্রেণির এই বিভাজন সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই বিরাজমান। তারপরও বিভাজিত শ্রমজীবী সমাজ সময়ে সময়ে অধিকার সচেষ্ট হয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে লড়েছে। সৃষ্টি করেছে মে দিবস। মে দিবস হচ্ছে শ্রমজীবীদের আন্দোলন। শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনের বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা। শ্রেণি-বৈষম্য দূরীকরণের এক ঐতিহাসিক নাম। অসহায় শ্রমজীবী সমাজের প্রতিবাদমুখর আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক দিবস সংগত কারণেই বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত।
একসময় অতি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শ্রমিকদের দৈনিক ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করতে হত। ইউরোপ ও মার্কিন পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করিয়ে নিত। এই অমানবিক জবরদস্তির প্রতিবাদে সংগঠিত হয়েছিলো শ্রমিক সমাজ। একতাবদ্ধ হয়ে গর্জে উঠেছিলো ১৮৮৬ সালের পহেলা মে। দিনে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শুরু করে ধর্মঘট। বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে নেমে যায় শিকাগো শহরের রাস্তায়। বেধে যায় পুলিশ-শ্রমিক খণ্ডযুদ্ধ। শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় আমেরিকার রাজপথ। শ্রেণি-বৈষম্যের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিনটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রতিষ্ঠা পায় শোষণমুক্ত একটি সমাজ। অর্জিত হয় শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি। নির্ধারিত হয় নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। ফলে মে দিবস হয়ে উঠে পুঁজিপতি শাসক শ্রেণির পৈশাচিক মানসিকতার বিরুদ্ধে চপেটাঘাত।
১৮৬৭ সালে কার্লমার্ক্স এর ‘ক্যাপিটাল গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির প্রথম খন্ডে ‘কাজের দিন’ নামক অধ্যায়ে কার্লমার্ক্স ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন এর উদ্যোগে পরিচালিত আট ঘণ্টা কাজের আন্দোলনকে সমর্থন করে। কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদের শ্রেণিস্বার্থের অভিন্নতা সম্পর্কে সেখানে দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে কার্লমার্ক্স লিখেছেন "ক্রীতদাসের দরুন মার্কিন প্রজাতন্ত্রের একটি অংশ বিকলাঙ্গ হয়ে থাকায় এতদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বতন্ত্র শ্রমিক আন্দোলন একেবারে পঙ্গু হয়েছিল। কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক যেখানে ক্রীতদাস সেখানে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক নিজেকে মুক্ত করতে পারেনা। ক্রীতদাসত্বের সমাধির উপরেই নবজীবনের অভ্যুদয় ঘটে। গৃহযুদ্ধের প্রথম অবদান হল দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের আন্দোলন - অবাধ গতিতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে অতলান্তিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত”।
শ্রমজীবী মানুষের কাছে মে দিবস একটি বিশেষ দিন হলেও কিছু কিছু শ্রমিকের কাছে মে দিবস পালন করা কেবল বিলাসিতা। মে দিবসে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও দিনমজুর শ্রেণির শ্রমিকদের কাজে বের হতে হয়। একটি দিন কাজ বন্ধ থাকলে বাড়ির চুলাও বন্ধ থাকে তাদের। কাজ না করলে আয় হয় না। আবার কলকারখানার শ্রমিকদের ছুটির দিনও কাজ করার প্রয়োজন হয়। দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও অধিকাংশ শ্রমিককে নিচে দশ ঘন্টা কাজ করতে হয়। অথচ ওভারটাইম বা হলিডে এলাউন্স জুটে না।
একটি দেশের জাতীয় উন্নয়নের সকল স্তরেই শ্রমিকরা সমানভাবে পরিশ্রম করে থাকে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবন নানাবিধ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কৃষিকাজ, গৃহস্থালি, গার্মেন্টস, নির্মাণশিল্প, ওষুধশিল্প, হস্তশিল্প, তাতশিল্প, খাদ্য-প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কোমল পানীয়শিল্প, চা-বাগান, আমদানি-রপ্তানিমুখী কারখানা, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিসহ সকলখাতে দেশীয় শ্রমিকদের সরব অংশগ্রহণ। এসব প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের যে মজুরি দেওয়া হয় তা জীবিকা নির্বাহের জন্য অপর্যাপ্ত। শ্রমিকদের এই মজুরিবৈষম্য সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব সেক্টরেই বিরাজমান। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও শ্রমবাজারের অন্যতম অংশ। নারী শ্রমিকরাও অনেকক্ষেত্রে মজুরি-বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে।
শ্রমশক্তি বিশ্বব্যাপী যতটা ব্যবহৃত হয় ততটা সমাদৃত হয় না। শ্রমশক্তির অন্যতম আবাসস্থল হচ্ছে চীন, ভারত ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি ক্ষুদ্রতম দেশ হলেও এখানে অগণিত শ্রমিক বিভিন্ন শিল্প কারখানায় উৎপাদনকর্মে নিযুক্ত। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এই গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই শ্রমিক অসন্তোষের চিত্র ভেসে ওঠে। মহাসড়কে রাস্তা ব্লক করে চলে শ্রমিক আন্দোলন। কিন্তু সে আন্দোলন কেন যেন ফলপ্রসু হয় না।
শ্রমিক দিবস প্রতিষ্ঠার ১৩৪ বছর পরেও শ্রমমজুরি নিয়ে সংগঠিত আন্দোলন একটি হতাশাজনক বিষয়। এই হতাশা বিশ্ব পুঁজির আগ্রাসী চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বৃহৎ পুঁজিপতিরা প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শ্রমশক্তি লুটে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের গ্রাসে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশেও বৈষম্যের নজিরবিহীন চেহারা দৃশ্যমান। অব্যাহত থাকছে পুঁজির কেন্দ্রীভবন। পুঁজিবাদ কর্মহীনতার সঙ্কটের জন্ম দেয়। বিপুল তরুণ প্রজন্মের শারীরিক শক্তি রয়েছে কিন্তু শ্রম দেওয়ার মত উপযুক্ত ক্ষেত্র নেই। মুলত এক শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের অর্ধশত ভাগ জমা রয়েছে। পুঁজিবাদ এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে সঙ্কট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষজন। পড়ছে মন্দার কবলে। উৎপাদন সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আর্থিক ক্ষেত্রেও গভীর সঙ্কট। একের পর এক ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে। এই সঙ্কট নয়া উদারনীতির চরম ব্যর্থতার প্রমাণ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণি বিভিন্নভাবে নিষ্পেষিত ও হতাশাগ্রস্ত। কোন কারণ ছাড়াই শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিক ছাঁটাই, কর্মসংস্থানের অভাব এবং ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তিতে ব্যর্থতা শ্রমিকশ্রেণির মনোবল ভেঙ্গে দেয়। একজন শ্রমিকের অন্যতম একটি অধিকার হচ্ছে নিরাপদ কর্মপরিবেশ। কিন্তু বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ প্রকৃতপক্ষে কতটা নিরাপদ তা কিছুদিন পরপর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির অগ্নিকাণ্ডই সাক্ষি দেয়। শ্রমিকশ্রেণি একরকম বিনা প্রতিরোধে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্য মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, গ্রিস, ইতালিসহ একের পর এক দেশে বিক্ষোভ ধর্মঘটে শামিল হয়েছে শ্রমিকশ্রেণি। অর্জিত অধিকার রক্ষায় তারা পথে নেমেছে। ফ্রান্সে এই লড়াই দীর্ঘস্থায়ী চেহারা নিয়েছিলো। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করে। সে আন্দোলন গণ আন্দোলনে রূপ নেয় না। কারণ রাজপথের আন্দোলন এত বেশি জনদুর্ভোগ বাড়ায় যে সেখানে সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকে না। আবার মজুরি বৃদ্ধির জোরদার আন্দোলন শুরু হলে মালিকপক্ষ গার্মেন্টস কারখানা চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এটিও শ্রমিকদের জন্য একটি দুশ্চিন্তার বিষয়।
অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষণা থেকে জানা যায় উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের শ্রম আইন ও শ্রম অধিকার সংস্কার অব্যাহত রাখা অতি জরুরি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ। এ উত্তরণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শ্রম আইন ও অধিকার নিশ্চিত করে শ্রমজীবী শ্রেণিকে মূলধারার সংযুক্ত করা উচিত। দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষসহ নিম্ন আয়ের সাধারণ জনগণ এক সংকটময় অবস্থায় দিন যাপন করছে। পরিবহণ শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, শিল্প-কারখানার শ্রমিকসহ শ্রমবাজারে নিয়োজিত সকল শ্রমিকদের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রের আন্তরিকতা প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে শ্রমিক শ্রেণি। শ্রমজীবী মানুষের মজুরি না বাড়লেও থেমে নেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। স্বল্প আয়ের শ্রমিক সমাজের ক্রয়ক্ষমতা সংকোচিত হয়ে গেছে। এই সংকট নিরসনে বাজারদরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত না হলে নিম্ন আয়ের শ্রমিক শ্রেণিকে অভুক্ত থাকতে হবে। শ্রমিক-কর্মচারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কারখানা ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক আবাসন, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। যেখানে স্বল্পমূল্যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। কর্মস্থলে সব ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রমজীবী মানুষকে সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে আয় বৈষম্য দূরীকরণে সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। আপামর জনসাধারণকে শ্রমিকবান্ধব করতে হবে। এজন্য পাঠ্যবইয়ে শ্রমের মর্যাদা বিষয়ক প্রবন্ধ/নিবন্ধ সংযুক্ত করতে হবে। এতে করে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে শ্রমজীবী সমাজ হতাশার অতল গহ্বর থেকে উঠে আসতে সমর্থ হবে।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক।
আমার বার্তা/খন্দকার আপন হোসাইন/এমই