বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ বায়ুদূষণ
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৫, ১৪:২০ | অনলাইন সংস্করণ
কমল চৌধুরী:

বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ, শব্দ দূষণ ও নদী দুষণ ।বায়ু দুষণের-জন্য আমাদের-রাজধানী ঢাকার বাতাস সর্বদাই দুষিত হচ্ছে। বায়ু দুষিত হবার বড় কারণ হচ্ছে ধুলোবালি। রাজধানীবাসী ধুলোবালির কারণে শুস্ক মৌসুমে দুর্ভোগে পড়ছেন। সরকারি হিসেবেই রাজধানীর বাতাসে ধুলোবালি সহনীয় মাত্রার তিন গুণ বেশি। ফলে একদিকে নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়ছে অন্যদিকে রোগবালাই। চিকিৎসকরা বলছেন, ধুলোযুক্ত বাতাসে সীসা, ইউরিয়া, প্যারাবিন বা থ্যালেট জাতীয় কিছু রাসায়নিক উপাদান থাকে। এগুলো দীর্ঘদিন শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে গিয়ে ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সক্ষম। ঢাকায় দুই সিটি কর্পোরেশন (উত্তর ও দক্ষিণ) এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি। ঢাকার ধুলোবালি নিরসনে ইতিপূর্বে হাইকোর্ট দুই সিটি কর্পোরেশনে পানি ছিটানোর নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ পালনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কিছুদিন রাস্তায় পানি ছিটিয়েছেন। পানি বন্ধ করে দেবার পর অবস্থা পূর্বের মতোই হয়ে যায়। তবু মানুষ ধুলোবালির মধ্যে নিরূপায় হয়ে ও রাস্তায় চলাচল করছে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সংস্থাটি ৯১টি শহরের মধ্যে যে ২৫টি শহরকে সবচেয়ে বেশি দুষিত বলে চিহ্নিত করেছে তন্মধ্যে বাংলাদেশের ৩টি শহর রয়েছে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর। বায়ুদূষণ জনিত কারণে মৃত্যুর দিকে ও বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুদূষণ জনিত রোগ-ব্যাধিতে বছরে ৯২ হাজার লোক মারা যায়। ঢাকা শহরে মরে যায় ১৩ হাজার ১০০ জন। সম্প্রতি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে দুষিত শহর হিসেবে ঢাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান খুবই ভয়াবহ। ধুলাবালি থেকে রক্ষা পেতে নগরবাসীর চেষ্টা কম নয়। কেউ ব্যবহার করছেন মাস্ক, কেউ ব্যবহার করছেন রুমাল, ওড়না। তাতে রক্ষা হচ্ছে না, শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণুমিশ্রিত ধুলা ফুসফুসে প্রবেশ করে। ফলে ফুসফুসের ক্যান্সার, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানি ও যক্ষ্মাসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি বাতাসে ক্ষতিকর উপাদান থাকলে ক্যান্সারের মতো রোগও হতে পারে। এ ছাড়া রাস্তার পাশে দোকানের খাবার প্রতিনিয়ত ধুলায় বিষাক্ত হচ্ছে। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম থাকায় তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে। রাজধানীর মিরপুর, কালশি, আগারগাঁও, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, বাবুবাজার, রায়েরবাজার, ধানমন্ডি, গাবতলী, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, মোল্লারটেক, দক্ষিণখান বাজার, মানিকনগর, মুগদা, শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, রামপুরা, বাড্ডা, বনশ্রী এলাকায় ধুলার আধিপত্য বেশি। বিশেষ করে রাস্তার ধারে বাড়িঘর, গাছ-গাছালিগুলোতে ধুলার মোটা আস্তরণ পড়ে আছে। গাছের পাতার রং সবুজ থেকে ধূসরে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর বাতাস অহরহ দুষিত হচ্ছে।
নগর কর্তৃপক্ষের দিক থেকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে গ্রিন সিটি করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেই উদ্যোগ? যেসব উদ্যোগ-পরিকল্পনার কথা শোনা গেছে তা এখনো কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেখানে ধুলার উপদ্রব থেকে রক্ষারই কোনো উদ্যোগ নেই, সেখানে আর কী হবে। ধুলায় রাজধানীর বহুমাত্রিক দূষণ রাতারাতি প্রতিকার করা সম্ভব নয়। তবে তা প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। হাইকোটের নির্দেশে ধুলা দূষণ ও এর ভোগান্তি রোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ‘ওয়াটার থেরাপির’ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এর বিশেষ কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। আমরা মনে করি, রাজধানীকে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও বাসযোগ্য করা জরুরি। তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ মুহূর্তে ধুলার দুর্ভোগ থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে হবে। নিয়মিত পানি ছিটিয়ে ধুলা নিবারণের পাশাপাশি প্রতিদিনের ময়লা আবর্জনা প্রতিদিনই পরিস্কার করতে হবে। রাজধানীর ধুলা দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ অধিদফতরের আইন থাকলে ও তা সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতরের অবহেলা ও অনীহার কারণে আইনের সঠিক প্রয়োগ নেই। সর্বোপরি, ধুলা দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষন আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদফতরকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আইকিউ এয়ার এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণের দিক থেকে গতবারের মতো এবারও বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।রাজধানী ঢাকাও দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে গতবারের অবস্থানে রয়েছে।আইকিউ এয়ার ভিজ্যুয়াল প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে ২০১৯ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। প্রকাশিত এ তালিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর রাজধানীর খেতাব জিতেছে দিল্লি।আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।কয়েক বছর আগেও যেসব শহরে বিষাক্ত ধোঁয়াশার উপস্থিতি ছিল সহ্যসীমার বাইরে তার মধ্যে অন্যতম ছিল বেইজিং।তিন বছর আগের দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় বেইজিংয়ের অবস্থান যেখানে ছিল ৮৪, এখন সেখানে তাদের অবস্থান ১৯৯।শহরের ধোঁয়াশাও কমিয়ে এনেছে তারা।আইকিউ এয়ার ভিজ্যুয়াল প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০১৯ থেকে এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার খেকে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।২০১৯ সালে বিশ্বের ৯৮টি দেশের সার্বক্ষনিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বস্তুকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটার (পি এম)২ দশমিক ৫ মানের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা নিকৃষ্ট শহরের পাওয়া যাবে।ফলে চীনারা যেভাবে বায়ুদূষণের লাগাম টেনে ধরেছে ,ঢাকার অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার আগে তাদের থেকে শিক্ষা নেয়া যেতে পারে।যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে চীনারা বিপদ আঁচ করে দূষণের লাগাম টেনে ধরেছে তা ঢাকাসহ বাকি শহরগুলোর জন্য শিক্ষনীয় হতে পারে ।প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সরকারী, বেসরকারী ,নাগরিক,সম্প্রদায় ও বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টার সমন্বয়ে বিশ্বের সব শহরের রিয়েল টাইম বায়ুর মানের ভিত্তিতে বায়ুর উপর তৈরি করা হয়।
তালিকায় নয়াদিল্লির পরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা অবস্থানে রয়েছে।বায়ু দূষণ ঠেকাতে একদিকে যেমন সফলতা দেখিয়েছে চীন ,অন্যদিকে ভারত সরকারের তরফ থেকে কিছু চেষ্টার কথা বলা হলেও তার ফল খুব একটা দৃশ্যমান নয়।অন্যদিকে শহরের তালিকায় বাংলাদেশের পর অবস্থানে আছে পাকিস্থান দ্বিতীয়,মঙ্গোলিয়া তৃতীয়,আফগানিস্তান চতুর্থ এবং ভারত পঞ্চম স্থানে রয়েছে।ক্যারিবীয় বাহমাস দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে সবচেয়ে ভালো বায়ুর তালিকায় শীর্ষে।পর্যায়ক্রমে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে পরবর্তীতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন আইল্যান্ড,আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া।দূষণের ক্ষেত্রগুলোর দিকে তাকালে চীন,ভারত এবং বাংলাদেশে বেশমিল ।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক-দৈনিক সকালের সময় ও দ্যা ডেইলি বেষ্ট নিউজ, ঢাকা।
আমার বার্তা/কমল চৌধুরী/এমই