রোহিঙ্গা ঢেউ, আরাকান আক্রমণ: তহবিল সংকটে তৎপরতা
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৫ | অনলাইন সংস্করণ
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন:

রোহিঙ্গাদের বাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে এখন পাঁচ লাখেরও কম রোহিঙ্গা রয়েছে, এবং আরাকান আর্মির চলমান নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে তারা তাদের বাসভূমি রাখাইন ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে এবং কক্সবাজার বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে, ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে। একদিকে রাখাইন রোহিঙ্গা শূন্য হওয়ার পথে অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারনে স্থানীয় জনগণ সংখ্যালঘু জনগুষ্ঠিতে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সাথে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নতুন করে সীমান্ত পেরিয়ে রাখাইন থেকে আসা আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এর মধ্যে জুন পর্যন্ত এক লাখ ২১ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছে বাকিরা নিবন্ধন ছাড়াই ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। অনেক রোহিঙ্গা ৩৩টি ক্যাম্পের বাহিরে উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমি এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। এসব কারনে রোহিঙ্গা সংকট দিন দিন জটিল আকার ধারন করছে। অবিলম্বে এই পরস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের মূল কারণ চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারনে কক্সবাজারের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বনভূমি পরিস্কার করে ক্যাম্প তৈরি করার কারনে সেখানকার বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। গত আট বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় কক্সবাজারের স্থানীয়রা শঙ্কিত। এই দীর্ঘ সময় ধরে স্থানীয় জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করে চলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে আসছে। রোহিঙ্গারা যেন কোনোভাবেই ভোটার হতে না পারে সেজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে স্থানীয় জনগণ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা, মাদক পাচার, মানব পাচার এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কক্সবাজার বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। এখানে পর্যটকরা শান্তি ও বিনোদনের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে আসে। এ কারনে পর্যটন এলাকায় সবসময় নিরাপত্তা ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের অবস্থান স্থানীয় বাসিন্দাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কারণে অপরাধ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। রোহিঙ্গারা চাঁদাবাজি, মাদক, খুন, অপহরণ ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও প্রশাসনকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ, শ্রমবাজার এবং খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে এটি এখন বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। শুধু মানবিক নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত এবং ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। প্রত্যাবাসন বিলম্বের কারনে স্থানীয়দের উপর চাপ বাড়ছে এর ফলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘাত তৈরি হবে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় জনগণের তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কয়েকগুন বেশি যার কারণে তারা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে পারছে না এবং মাদকের কারনে তরুন প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে। সামাজিকভাবে নিরাপত্তা সংকট, মাদক ব্যবসা, অপহরণ পর্যটন শিল্পের উপর হুমকি বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ, বর্জ্য সমস্যা এবং বনভূমির ক্ষতির মত পরিবেশগত ঝুঁকি বেড়ে গেছে। একই সাথে ক্যাম্পগুলোতে পানি, স্যানিটেশন এবং অন্যান্য মৌলিক পরিষেবার সংকট দেখা দিয়েছে, সামাজিক কাঠামোতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, সংক্রামক রোগের ঝুঁকিও বেড়ে গেছে।
রাখাইন পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল নয়। রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক সমাধান না হলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সমন্বিত আক্রমণ চালাবে এবং আরাকান আর্মির কাছ থেকে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ নিবে। সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষ চললে বাংলাদেশের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনে আবার দুর্ভোগ নেমে আসবে। এর আগে আরাকান আর্মির আক্রমণে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বি জি পি পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। আরাকান আর্মির উপর বিমান হামলা ও স্থল পথে আক্রমণ চললে তারা বাংলাদেশ আশ্রয় নিবে এবং সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হলে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা ও জনগন ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
বর্তমানে আরাকান আর্মি আরেক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, তাদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জেলেদের স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকা ব্যাহত হচ্ছে এবং স্থানীয়দের মাঝে অসন্তোষ ও আতংক বিরাজ করছে। দিন দিন আরাকান আর্মির দৌরাত্ম বেড়েই চলছে যা চলতে দেয়া যায় না। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত আরাকান আর্মি সাগর থেকে ৯৫ জন বাংলাদেশি এবং ১৩৩ জন রোহিঙ্গা সহ ২২৮ জন জেলেকে ধরে নিয়ে যায়। বিজিবির প্রচেষ্টায় ১২৪ জনকে ফেরত আনা হয়েছে এবং আরাকান আর্মির হাতে ১২টি ট্রলারসহ ১০৪ জন জেলে আটক রয়েছে। বিজিবি আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম, মাইন বিষ্ফোরণ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধে সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমান্ত এলাকায় জনসচেতনতামূলক সভা, লিফলেট বিতরণ, জনমত তৈরি ও জেলেদের নাফ নদীতে বাংলাদেশের জলসীমা অতিক্রম না করার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে।
আরাকান আর্মির সাথে জান্তা সরকারের মধ্য সংঘর্ষের কারণে রাখাইনে জ্বালানী তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা রাখাইনে পাচারের জন্য মালামাল মজুদ করছে এবং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত জ্বালানি তেল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সার পাচার করছে। এসব পণ্যের বিপরীতে মিয়ানমার থেকে ভয়ঙ্কর মাদক, ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, ইয়াবা ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য আমাদের দেশে আসছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিজিবি ১২ কোটির বেশি নগদ অর্থ, বিপুল পরিমান ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ, হেরোইন, গাঁজা, বিদেশি মদ, কোকেন ও আফিম উদ্ধার করেছে যার বাজারমূল্য প্রায় ৮৯৩ কোটি টাকা। এসব কাজে জড়িত থাকার কারনে বি জি বি ২ হাজার ৬৩৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। অপরাধমুলক কর্মকাণ্ড, মাদক পাচার এসব বন্ধ করতে হলে আরাকান আর্মির সাথে সরকারী ও স্থানীয় পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি জরুরী ভিত্তিতে আরাকান আর্মিকে এধরনের কাজ থেকে নিবৃত্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে দক্ষ ও তৎপর। সঠিক দিক নির্দেশনার মাধ্যমে তাদের পেশাদারিত্ব ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিচালনায় ডব্লিউ এফ পি বর্তমানে বড় ধরনের তহবিল সংকটে পড়েছে। মানবিক সহায়তার পরিমান আগের তুলনায় প্রায় ৭০ ভাগ কমে গেছে। বর্তমানে যে ফান্ড আছে তা দিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চালানো যাবে বলে জানা যায়। আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়ন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন মানবিক সহায়তা প্রকল্প সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তহবিল সংকটের কারনে বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিশেষ করে ক্যাম্পে কর্মরত রোহিঙ্গারা তাদের চাকুরী হারাচ্ছে এবং অনেকে জীবিকার তাগিদে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ফলে ক্যাম্পে নিরাপত্তা সংকট বেড়েছে। চাকরি হারিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনেক রোহিঙ্গা নারী রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এভাবে তহবিল সংকট চলতে থাকে তবে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্লেষকদের মতে, সংকট সমাধানে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে, নারীদের জন্য বিশেষ পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট একটি মানবিক সমস্যা হলেও, এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব স্থানীয় মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টি করছে। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় আয় হ্রাস পেয়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার সুযোগে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। যুবসমাজ বেকারত্ব ও হতাশা থেকে মাদক ব্যবসা ও সেবনে জড়িয়ে পড়ছে এবং সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। কারা এর থেকে লাভবান হচ্ছে তা দেখতে হবে ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল বাড়াতে এবং তাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক প্রয়াস জোরদার করতে বর্তমানে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কথা বলার পক্ষে তাদের মত জানায়। এই সংকট নিরসনে বৈশ্বিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। রোহিঙ্গা সংকটের শুরু মিয়ানমারে এবং এই সমস্যার সমাধানও সেখানে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা সব পক্ষকে দ্রুততম সময়ে দৃঢ়তার সাথে এই সংকট সমাধানে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাশে রয়েছে এবং রাখাইনে তাদের দ্রুত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এই সংকট সমাধানে মিডিয়াকে ইতিবাচক ও কার্যকরী ভুমিকা রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এই সমস্যা সমাধানে দেশের সকল স্তরের জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি দল মত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল অংশী জনের সহায়তায় এই সংকট সমাধানে তৎপর হতে হবে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
আমার বার্তা/ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন/এমই