মিয়ানমার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও রোহিঙ্গা ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:১৯ | অনলাইন সংস্করণ
ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন:

মিয়ানমারে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকট এখন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে চলমান নানা সমস্যার পাশাপাশি এই সংকট মোকাবেলায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দিন দিন জটিল হচ্ছে এবং এই সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তা কমতে থাকায় সংকট সমাধান ঝুঁকির মুখে পড়ছে। এর সাথে এখন ভু-রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক বিষয়গুলোও যোগ হয়েছে। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরে না আসলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আরো বিলম্বিত হতে পারে এজন্য অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে এই সংকটের সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
চলমান গৃহযুদ্ধ বন্ধে জান্তা সরকার চীনের সহায়তায় থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্সের মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে তাদের কার্যক্রম সীমিত করার চেষ্টা করছে। গত চার বছরের গৃহযুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত সশস্ত্র গুষ্ঠিগুলোর বিজয়ের মূল কারণ ছিল তাদের মধ্যেকার ঐক্য এবং সমন্বিত আক্রমণের কৌশল। জাতিগত সশস্ত্র গুষ্ঠিগুলো দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকার পরও যে বিজয় পায়নি তা তারা একতাবদ্ধ হয়ে একযোগে আক্রমণ পরিচালনা করায় পেয়েছে। এই সংগ্রামে মিয়ানমারের অন্যান্য অংশে সশস্ত্র গুষ্টিগুলোর বিজয়ের পাশাপাশি আরাকান আর্মি (এ এ) গত এক বছর ধরে প্রায় পুরো রাখাইন রাজ্য এবং চিন রাজ্যের পালেতোয়া তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে এবং রাখাইনের বাকী তিনটি শহরতলী দখলের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমারের চলমান সশস্ত্র সংগ্রাম ক্রমবর্ধমান অস্ত্র ও গোলাবারুদের তীব্র ঘাটতির কারনে বর্তমানে সংকটের মুখোমুখি। আগস্ট মাসে চীনের চাপের মুখে ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এম এন ডি এ এ), তা'আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টি এন এল এ) এবং শান স্টেট প্রগ্রেস পার্টি সহ গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেরকে অস্ত্র এবং আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিবে বলে জানায়। এর ফলে আক্রমণের তীব্রতা কমে যাবে এবং মিয়ানমার জান্তা নতুন করে প্রতিআক্রমণের সুযোগ পাবে। সশস্ত্র গুষ্ঠিগুলো একই সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর চাপ দিতে না পারলে তাদের বিজিত এলাকাগুলো হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে সশস্ত্র গুষ্ঠিগুলোর দখল করা কিছু এলাকা মিয়ানমার সেনাবাহিনী পুনঃদখল করেছে ও জাতিগত সশস্ত্র গুষ্ঠিগুলো চাপের মধ্যে আছে।
সম্প্রতি অক্টোবর মাসে চীনের মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনার পর টি এন এল এ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই যুদ্ধবিরতির পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী মান্দালয়, কাচিন, চিন, কারেন এবং রাখাইন রাজ্যে তাদের সৈন্য সমাবেশের সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এসব অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে তাদের হারানো এলাকাগুলো দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী মান্দালয় অঞ্চলে তাদের আধিপত্য ফিরিয়ে এনেছে এবং ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের নিয়ন্ত্রণে থাকা উত্তর শান রাজ্যে চীন সীমান্ত পর্যন্ত একটি শক্তিশালী বাণিজ্য করিডোরে তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে মিয়ানমার সরকার তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে, সশস্ত্র গুষ্টিগুলো তাদের আয়ের উৎস হারাচ্ছে এবং একই সাথে অস্ত্র সরবরাহ পেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
উত্তর শান রাজ্যে টিএনএলএ’র সাথে চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে রাখাইনে এ এ’র অবস্থান এবং এ এ’র দখলকৃত বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে। মিয়ানমার জান্তা বিমান, নৌবাহিনীর জাহাজ, আর্টিলারি এবং ড্রোনের সাহায্যে এ এ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার পাশাপাশি চকপিউ এবং সিতওয়ে অঞ্চলের বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাচ্ছে। চীন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্সের শরীক দল এম এন ডি এ এ এবং টি এন এল এ কে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ বন্ধের জন্য চাপ দিয়ে জান্তার সাথে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরে বাধ্য করলেও ভৌগোলিক দূরত্বের কারনে রাখাইনের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণকারী এ এ’কে এখনও এই চাপের আওতায় আনতে সমর্থ হয়নি। এ এ বর্তমানে রাখাইনের সিতওয়ে এবং চকপিউ শহরতলী দখলের চেষ্টা করছে।
জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই নির্বাচন কতটুকু সাফল্যের মুখ দেখবে তা বলা যাচ্ছে না। মিয়ানমার জান্তা নির্বাচনের আগে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য পাল্টা আক্রমণ এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর বিমান হামলা বাড়িয়েছে, এর ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স এর তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে ২২,৫০০ জনেরও বেশি রাজনৈতিক বন্দী এখনও আটক রয়েছে এবং ৭,৪২৩ জন জান্তা বিরোধী নিহত হয়েছে। মিয়ানমার সরকার প্রথম ধাপের নির্বাচন ২৮ ডিসেম্বর ১০২টি টাউনশিপে এবং দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন ১১ জানুয়ারী ১০০টি টাউনশিপে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জানায়। দ্বিতীয় ধাপের এই এলাকাগুলো এখনও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাখাইন এবং চিন রাজ্যে দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে না, এই দুটি রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকাই সশস্ত্র গুষ্ঠির নিয়ন্ত্রণে। সরকার ইতিমধ্যেই রাখাইনের সিতওয়ে, চকপিউ এবং মানাউং শহরতলি প্রথম ধাপে ভোটগ্রহণের জন্য অন্তর্ভুক্ত করেছে। রাজ্যের বাকি ১৪টি শহরতলি এ এ’র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মোট ৫৭টি দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, যার মধ্যে ছয়টি দেশব্যাপী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং বাকিরা রাজ্য বা আঞ্চলিক সংসদের আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। জান্তার সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সবচেয়ে বেশী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। এদের বেশীরভাগই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।
মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না বলে তিনি তার মত ব্যক্ত করেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে আঞ্চলিক নেতারা জানায় যে, আসিয়ান প্রণীত পাঁচ দফা ঐকমত্য বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়াতে তারা মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কোন পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।
মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট জটিল অবস্থানে রয়েছে এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তার পরিমান কমে আসছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৩০০ মিলিয়ন এবং যুক্তরাজ্য ৪৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুদান ৭২ শতাংশ কমে ৮৫ মিলিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের অনুদান ৪৮ শতাংশ কমে ২৪ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এই ঘাটতি সামলাতে এক বছরে রোহিঙ্গা খাতে বাংলাদেশের ব্যয় বেড়েছে ২৬৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিলেও এ বছর প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও চীনের একার পক্ষে এই সংকট সমাধান সম্ভব হবে না, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানায় যে, এই সংকট সমাধানে চীন তার ভূমিকা পালন করবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানায় যে, অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমার সরকার ও এ এ’র ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করে রাখাইনে তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ শুরু করতে হবে।
ত্রাণ সরবরাহ কমতে থাকায় রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল হবে এবং বাংলাদেশের পক্ষে সামনের দিনগুলোতে রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল এই ব্যয়ের বোঝা বহন করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ এই সমস্যা উত্তরণে কাজ করে চলছে এবং সকল স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে এই সংকট মোকাবেলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকার এপর্যন্ত কোন কার্যকরী পরিকল্পনা নেয়নি। এ এ ও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য যে সদিচ্ছার দরকার তার কোন আভাস মিয়ানমার সরকার কিংবা এ এ’র পক্ষ থেকে এখনও পাওয়া যায়নি। সামনের নির্বাচনে অংশ নেয়া বেশীরভাগ প্রার্থী সেনাবাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত। রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মনোভাব পরিবর্তন না হলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রত্যাবাসনে অগ্রগতি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আসিয়ান ও আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারে নির্বাচনকে স্বীকৃতি না দিলে নতুন করে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, ফলে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পথ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। থ্রি ব্রাদারহুড এলায়েন্সের একতায় ফাটল ধরলে এ এ কোণঠাসা হয়ে পড়বে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী একযোগে রাখাইনে আক্রমণ চালিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাবে। এর ফলে রাখাইনের চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এর প্রভাব পড়বে। চলমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা চলমান রাখার উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সজাগ থাকতে হবে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
আমার বার্তা/ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন/এমই
