ক্লাউড, স্টোরেজ ও ইন্টারনেট গেটওয়ের স্বনির্ভরতা অর্জনে বাংলাদেশের করণীয়

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ২২:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ

  সাকিফ শামীম:

একবিংশ শতাব্দীর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো (ICT Infrastructure) এখন একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। ডিজিটাল রূপান্তরে বাংলাদেশ যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, তা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হলেও বিদেশী ক্লাউড পরিষেবা, ডেটা স্টোরেজ ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ের ওপর কৌশলগত নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে দেশের ডেটা সার্বভৌমত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বিশেষ করে ক্লাউড অ্যাক্টের মতো আন্তর্জাতিক আইন বিদেশে সংরক্ষিত ডেটাকে বিদেশী বিচারিক কর্তৃপক্ষের আওতায় এনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।

এ প্রেক্ষাপটে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা—যেমন ব্যাংকিং লেনদেন, নাগরিক তথ্য, সরকারি গোপন নথি, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত তথ্য এবং স্বাস্থ্যসেবার সংবেদনশীল ডেটা—দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যেই সুরক্ষিত রাখা এখন আর কেবল প্রযুক্তিগত চাহিদা নয়; এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা অগ্রাধিকার। এজন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ও স্বনির্ভর ডেটা কৌশল বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ক্লাউড অবকাঠামো শক্তিশালী করতে নীতিগত ও কাঠামোগত বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ‘ক্লাউড কম্পিউটিং নীতিমালা ২০২৩’ প্রণয়ন এবং সরকারি ডেটা দেশীয় ক্লাউডে সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ ভবিষ্যৎ ডেটা সুরক্ষার ভিত্তি তৈরি করেছে। এছাড়া টিআইআর-৪ মানের ডেটা সেন্টার নির্মাণ এবং BDCCL–ওরাকল সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘সার্বভৌম ক্লাউড’ (Sovereign Cloud) দেশের ডেটা যাতে দেশের বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশেষত ফিনটেক, ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা ও ই-গভর্ন্যান্সের মতো সংবেদনশীল খাতে এই অবকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ডেটা গোপনীয়তা এবং নিয়ন্ত্রক সম্মতি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।

ডেটা স্টোরেজ ও ক্লাউড সক্ষমতায় স্বনির্ভর হয়ে উঠলে অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হবে। বিদেশী ক্লাউড পরিষেবায় বাংলাদেশ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে, যদি স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশের অভ্যন্তরেই প্রযুক্তি শিল্প আরও সম্প্রসারিত হবে। পাশাপাশি স্থানীয় উদ্ভাবক, স্টার্টআপ এবং গবেষকদের জন্যও এর নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।
বাংলাদেশের স্মার্ট নেশন গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হবে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। AI ও মেশিন লার্নিং মডেল প্রশিক্ষণে উচ্চ-পারফরম্যান্স কম্পিউটিং (HPC) অপরিহার্য, যা বিদেশী ক্লাউডে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সার্বভৌম ক্লাউডের মাধ্যমে দেশের গবেষক, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, কৃষি প্রযুক্তিবিদ ও উদ্ভাবকরা নিজের দেশের মাটিতেই নিরাপদ, দ্রুততর এবং সাশ্রয়ী HPC সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন। এর ফলে স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও জলবায়ু অভিযোজনের মতো খাতে স্থানীয় ডেটা ব্যবহার করে বিশেষায়িত AI ড্রিভেন সমাধান তৈরি করা আরও সহজ হবে।

একইভাবে আন্তর্জাতিক সংযোগে নির্ভরতা কমানোও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশ বর্তমানে সাবমেরিন কেবল এবং সীমিত স্থলপথের আন্তর্জাতিক গেটওয়ের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা দূর করতে তৃতীয় ও চতুর্থ সাবমেরিন কেবল সংযোগের কাজ চলছে, যা দেশের নেটওয়ার্ক রিডান্ডেন্সি ও স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে। পাশাপাশি ITC সংযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশের সাথে স্থলভিত্তিক ইন্টারনেট রুট আরও শক্তিশালী হচ্ছে, যা জাতীয় নেটওয়ার্ককে আরও নিরাপদ, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য করবে।

বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবার সংযুক্তি। দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল, উপকূলীয় চরাঞ্চল, নদীবিধৌত বিচ্ছিন্ন গ্রাম—যেসব স্থানে প্রচলিত ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায় না বা স্থিতিশীল থাকে না, সেখানে স্টারলিংক উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক এই সংযোগ দেশের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে আরও গতিশীল করবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি প্রযুক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সেবার মতো ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক ব্যবধান কমিয়ে নিয়ে আসবে। বিশেষ করে গ্রামীণ উদ্যোক্তা, টেলিমেডিসিন, অনলাইন লার্নিং ও রিমোট মনিটরিং সেবাগুলো স্টারলিংকের স্থিতিশীল ও দ্রুত গতির ইন্টারনেটের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হবে।

তাই আমি মনেকরি এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট—ডেটাকে দেশের ভেতরেই নিরাপদ রাখা, প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করা এবং ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। তবে অবকাঠামো নির্মাণই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা, ক্লাউড আর্কিটেকচার ও ডেটা সায়েন্সে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা এবং দেশীয় উদ্ভাবকদের আরও উৎসাহিত করা। এই ভিত্তি আরও মজবুত করতে পারলে ‘দেশের ডেটা দেশে থাকুক’—এই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্মার্ট জাতির ভিশন বাস্তবায়নে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে এবং একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি খাতে স্থায়ী অগ্রগতি অর্জন করবে।


লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।

আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই