স্মার্টফোনে আত্মহত্যার প্রবণতায় নিতে হবে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৪, ১৪:২৬ | অনলাইন সংস্করণ
শাহীন আলম:

- চাপের সাথে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিও
- একাকিত্ব হয়ে মোবাইলে আসক্ত, পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি এবং হতাশা অন্যমত
- ২০৩০ সালের মধ্যে বিষণ্নতা হবে বিশ্বের একমাত্র রোগ- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
আবুবক্কর সিদ্দিকের বয়স ২৫ বছর। চার মাস আগেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ, চাকরি করতেন একটি দোকানে। অথচ এখন তার ভবঘুরের মতো অবস্থা। প্রতিনিয়তই থাকেন টেনশনে। তার ধারণা, তাকে কে বা কারা যেন আঘাত করে প্রতিনিয়ত। মাথায় প্রচুর চাপ লাগে, কে যেন গলা চেপে ধরে। শরীরের ভেতরের বিভিন্ন কিছু যেন আলাদা হওয়ার মতো অবস্থা হয় বলে জানান আবুবক্কর। গতকাল রবিবার তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি আর পারছি না। আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কোন এক ডিভাইজ দিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করা হচ্ছে। এদিকে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ মানসিক রোগ বলে উল্লেখ করেছেন মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজের এডিশনাল ডিআইজি মো. সোহেল রানা। নিয়মিত চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং করলে এর রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। তিনি আমার বার্তাকে বলেন, হতাশা এবং একাকিত্ব থেকে এ রোগের শুরু। এই রোগীরা স্বপ্ন এবং বাস্তবতাকে আলাদা করতে পারে না। দিনের বেলাতেও নিজেকে স্বপ্নের মতো মনে করেন। ছাদের হাফ ওয়ালকে সিঁড়ি মনে করেন। আর হাফ ওয়ালে উঠে সিঁড়ির মতো পা বাড়ায় আর তখনি নিচে পড়ে যায় আর মৃত্যু হয়।
অপরদিকে স্মার্টফোন ব্যবহার, বিভিন্ন ডিভাইজে গেমস খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে তুরুণরা। আর এই আসক্তই এক সময় ডেকে আনে বিপদ। হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় তারা। মনরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এসব গেমিংয়ের আসক্তি থেকে আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিতে পারে। তাই তাদের রক্ষা করতে অভিভাবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিগো লাইফ, লাইকি, টেলিগ্রাম, টেংগোসহ বেশ কিছু অ্যাপ আছে যেগুলোতে সারাদিন চলে অশ্লিলতা। আর তরুণরা এই অ্যাপগুলোতে আষক্ত হয়ে পড়ছে। এই তালিকায় প্রবাশী যুবকরা জড়িয়ে পড়ছে অনেক। তারা অবসর সময়টায় এই অ্যাপগুলোতে ঢুকে প্রচার টাকা অপচয় করছে। এক শ্রেণীর তরুণী এবং মধ্য বয়সীরা মহিলারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দেখিয়ে টাকা আদায় করছে।
শিশুর কাছে সেলফোন দেয়া নিয়ে বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় নানা নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্যাপিয়েন ল্যাবসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নতুন তথ্য। শিশুদের হাতে স্মার্টফোন বা ডিভাইস দেয়ার বিষয়টি শুধু ঝুঁকিপূর্ণ নয়, বরং অল্প বয়সে সেলফোনের মালিকানা শিশুদের ভার্চুয়াল ব্যস্ততা বৃদ্ধি, আত্মসম্মানবোধ ও আত্মহত্যার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে। ৩৪টি দেশের ২৭ হাজার ৯৬৯ জন জেনারেশন জেড (১৯৯০-এর শেষ ও ২০০০ সালের শুরুর দিকের প্রজন্ম) তরুণের (বয়স ১৮-২৪ বছর) তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। মহামারি শুরুর আগে এ বয়সের তরুণদের মানসিক সুস্থতা কমতে শুরু করে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। কমন সেন্স মিডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩-১৮ বছর বয়সি কিশোররা এন্টারটেইনমেন্ট স্ক্রিনে প্রতিদিন গড়ে ৮ দশমিক ৪ ঘণ্টা ব্যয় করছে। এছাড়া যাদের বয়স ৮-১২ বছরের মধ্যে তারা গড়ে ব্যয় করে ৫ দশমিক ৩ ঘণ্টা করে। শিশুদের ওপর সেলফোনের সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা করে বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্যাপিয়েন ল্যাবসের সমীক্ষা অনুসারে, ১৮-২৪ বছর বয়সের মধ্যে যারা তুলনামূলক বেশি বয়সে তাদের প্রথম সেলফোন (বা ট্যাবলেট) পেয়েছে, অন্য শিশুর তুলনায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভালো পর্যায়ে রয়েছে। তাছাড়া তারা আত্মহত্যার চিন্তা, অন্যদের প্রতি শত্রুতামূলক মনোভাবসহ কম মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত এবং কম বাস্তববিচ্ছিন্ন।
গবেষকরা বলছেন, গবেষণার এটাই নির্দেশ করে যে যারা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছেড়ে খেলাধুলা, ব্যায়াম, বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি আড্ডায় সময় ব্যয় করে, তাদেরই সুখী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে সীমিত সময়, যেমন দিনে এক বা দুই ঘণ্টা স্মার্টফোন বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনে সময় ব্যয় করাটা নিরাপদ। গবেষকরা পরামর্শ দেন, ১৮-২৪ বছর বয়সের তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের ধারাবাহিক পতন প্রবণতার জন্য সেলফোন দায়ী হতে পারে। কেননা ইন্টারনেট যুগের আগে, বয়স ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত তরুণরা প্রায় ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার ঘণ্টা পরিবার, বন্ধু বা পরিচিতদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও আলাপচারিতায় ব্যয় করত।
বেশ কিছুদিন আগে এক বিবৃতিতে আইসাকা ও সিসিএ ফাউন্ডেশন বলছিলেন, এখনকার তরুণদের খেলা প্রায় সব ভিডিও গেম সন্ত্রাসী ধরনের হয়ে থাকে। কীভাবে একজনকে মেরে একটি শহর দখল করা যায়, কীভাবে একটি জাতিকে শেষ করে দেয়া যায়, তা তরুণরা ভিডিও গেমস থেকে শিখছে। ফলে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং তৈরির মাধ্যমে সহিংস ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এর থেকে পার পেতে হলে পরিবার ও রাষ্ট্রের বড় ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকরী উদ্যোগ নিয়ে ‘সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গেমিংয়ে আসক্তি বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত পরিস্থিতিই দায়ী। বাচ্চাদের আসক্তির কারণ হচ্ছে তারা বাইরে খেলাধুলা করতে না পারা। ফলে বেশিরভাগ বাচ্চারা অনলাইন ভিডিও গেমস কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর সময় ব্যয় করছে। মূলত সময়ের অপব্যবহারই আসক্তিকে বাড়াচ্ছে। সাময়িক মানসিক একটা প্রশান্তি পেয়ে বাচ্চারা অনেকক্ষণ গেম খেলছে। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত গেমিংয়ের ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সুদূরপ্রসারি চিন্তা করলে পরবর্তীতে এটির প্রভাব আরও বেড়ে যাবে।
এককালে মানুষ আত্মহত্যা করত অন্যের জীবন রক্ষার জন্য, কখনো শোকের কারণে, কেউবা ধর্ষণের জন্য লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে। কেউ কেউ নিজের জীবনকে নিজেই শেষ করার এই কাজ করত সামরিক পরাজয়ের মতো অসহিষ্ণু পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি পেতে কিংবা শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের জন্য। কথা হলো, এখনকার সময়ে আত্মহত্যার কারণ কী একই? সভ্যতায় আমরা অনেক এগিয়েছি। শিল্পবিপ্লবের চতুর্থ পর্যায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে আমাদের জীবনধারা ও বোধ একেবারেই আগের মতো নেই। কিন্তু আত্মহত্যা কখনো থামেনি; বরং আজকাল আরো বাড়ছে।
বেশকিছুদিন আগে ফেসবুক লাইভে নিজের মাথায় পিস্তল তাক করে এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পুলিশ গণমাধ্যমকে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, দীর্ঘ দিনের একাকী জীবন, ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই, ব্যবসায় লোকসান, এসব কিছু থেকে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন আটান্ন বছর বয়সি ঐ ব্যবসায়ী। সেটিই তার আত্মহননের পথ বেছে নেয়ার কারণ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তাদের মতে, সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে আত্মহত্যার হার বেড়েছে। এই বৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে দেখা যায়। আর আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় সংখ্যক দেশ চীন এবং ভারত, মোট অর্ধেকেরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়েস পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। একই ভাবে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ।
তরুণদের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখন অনলাইনভিত্তিক মিডিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ভিডিও বা ব্লগে আত্মহত্যার বিবরণটির সঙ্গে এই কাজটির বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায় কেউ কেউ। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজের কারণে। এভাবে কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে আত্মহত্যার প্রশংসা বা রোমান্টিসাইজ করা হয়। আবার সংবাদ মাধ্যমে বা ভিডিওতে যখন একটি নির্দিষ্ট উপায় কী করে নিজেকে হত্যা করা যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়, তখন এটির প্রবণতা বাড়তে পারে। এসব ঝুঁকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিষণ্নতা হবে বিশ্বের একমাত্র রোগ। এটি প্রতিরোধে এখন থেকে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে।
আমার বার্তা/শাহীন আলম/এমই