নিমাইচাঁদের পুণ্যস্নানে মানুষের ঢল

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৪১ | অনলাইন সংস্করণ

  প্রিন্ট ভার্সন:

দক্ষিণ মানিকগঞ্জের বালিরটেক বাজার সংলগ্ন কালিগঙ্গা নদীতে নিমাইচাঁদের পুণ্যস্নানে মানুষের ঢল -আমার বার্তা

রতন বালো, বালিরটেক (মানিকগঞ্জ) ঘুরে এসে:

ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী নিমাইচাঁদের স্নানোৎসবে হাজার হাজার পুণ্যার্থীদের ঢল নেমেছে। আয়োজন কমিটির ধারণা, এবার ৮ থেকে ১০ হাজার পুণ্যার্থীদের সমাগম হবে।

মানিকগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, হরিরামপুর, শিবালয়সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব পুণ্যার্থী নিমাইচাঁদের স্নানে অংশ নেন। গত ১৫ এপিল সোমবার দক্ষিণ মানিকগঞ্জের বালিরটেক বাজার সংলগ্ন কালিগঙ্গা নদীতে এ স্নান সম্পন্ন হয়। সকাল ৮টা থেকে এ স্নান শুরু হয়ে টানা চলে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত।

তীর্থ যাত্রীরা পুণ্য লাভের আশায় স্নান করার জন্য সোমবার ভোর থেকে সমবেত হতে থাকেন বালিরটেক বাজার সংলগ্ন কালিগঙ্গা নদীর তীরে। এ উপলক্ষে মানিকগঞ্জের সদর থানার ভাড়ারিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে বসেছে ১৫ দিনব্যাপী ‘নিমাইচাঁদের মেলা’। ১৫ এপ্রিল ২ বৈশাখ কালিগঙ্গা নদীতে নিমাই চাঁদের স্নানের মধ্য দিয়ে মেলা শুরু হয়েছে।

প্রতিবছর পুণ্যস্নানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ হিন্দু-মুসলমান উপস্থিত হয় এবং ১৫ দিন আগে থেকেই এ এলাকায় বাড়ি বাড়ি শুরু হয় বিভিন্ন প্রস্তুতির পালা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়-অনাত্মীয়তে বাড়ি ভরে যায়।

এ অঞ্চলে এটি সবচেয়ে বড় উৎসব। আর সব ধর্মাবলম্বীও এ উৎসবে উপস্থিত হয়। মেলায় বিভিন্ন রকমের  দোকান, পুতুলনাচ,  দোলনচাঁপা বসে। পুণ্যার্থীরা বালিরটেক নদীর ঘাটে কালিগঙ্গা নদীতে ঘুরে ঘুরে পুণ্যস্নানে অংশ নেন। বিশেষ করে সবারই লক্ষ্য ছিল নিমাইচাঁদের নিচ দিয়ে পুণ্যস্নানে অংশ নেয়া। ফলে এখানেই সবচেয়ে  বেশি ভিড় লক্ষ্য করা যায়।

পুণ্যস্নানে অংশগ্রহণকারীদের জন্য বালিরটেক বাজার হরিসভা বাজার কমিটি আয়োজিত ভক্তসেবার আয়োজন করা হয়। ভোর রাত থেকে বালিরটেক কালী মন্দির প্রাঙ্গণে এ ভক্তসেবার জন্য রান্না করা হয়। বিরতিহীন বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে খিচুড়িপ্রসাদ বিতরণ।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক  ভোলানাথ রায়  মেলা ও স্নানের শুরুর কথা বলতে গিয়ে তাদের দুঃখের কথা বলেন। আগে তাদের মুরুব্বিরা মেলার কার্য পরিচালনা করতেন, কারো অনুমতি নিতে হতো না। শুধু স্থানীয় চেয়ারম্যানের সম্মতিতেই চলতো। পরে এসডিও অনুমতি দেন।

তিনি বলেন, এখন অনুমতি নিতে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত দৌড়াতে হয়। শুধু মন্ত্রণালয় পর্যন্ত  গেলেই চলে না, এর জন্যে ঘাটে-ঘাটে বাধা সৃষ্টি হয়। এই বাধা অতিক্রম করতে ‘তৈল’ প্রয়োগ করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নিমাইচাঁদের  মেলা ও পুণ্যস্নান উৎসব বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আজ থেকে প্রায় ৩শ’ বছর আগে পদ্মা নদীর ওপারে ফরিদপুর নামক স্থানে জনৈক কাঠমিস্ত্রি তার বাড়িতে একটি নিমগাছ লাগিয়েছিলেন। প্রতিদিন তিনি নিমগাছের তলা পরিষ্কার করে রাখতেন। গাছ যখন বড় হয়, তখন একদিন ওই গাছের ভেতর  থেকে  দৈববাণী শুনতে পান মিস্ত্রী। গাছের কাণ্ডের অংশ দিয়ে মূর্তির মতো করে নিমাইচাঁদ নামক কাঠের দেবতা  তৈরি করার আদেশ পান তিনি।

তখন মিস্ত্রী দৈববাণী মোতাবেক কাঠের  দেবতা তৈরি করেন। নিয়মিত পূজা অর্চনা করতে থাকেন। একদিন মিস্ত্রির বাড়িতে আগুন লাগে। তখন মিস্ত্রি রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আমি তোর পূজা করি। আমার বাড়িতে আগুন লাগলো কী করে’। তখনই কাঠের দেবতাকে তিনি আড়ইল বিলে ফেলে দেন।’

সে সময় বিলের তীরে বাস করতেন জনৈক এক নারী পুণ্যার্থী। তিনি  দেখতে  যেমন সুন্দরী তেমনী ধর্মপ্রাণও ছিলেন। তিনি বিল  থেকে নিয়মিত জল আনতেন। একদিন  সেই  দৈববাণীর মতো শব্দ শুনতে  পেলেন। প্রথমে তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।

পরের দিন আবার  দৈববাণী হলো, ‘তুই আমাকে জল থেকে তুলে নে’। তখন তিনি বিল থেকে কাঠের দেবতাকে তুলে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। দেবতার নিয়মিত পূজা অর্চনার কথাও স্বপ্নে জানতে পারলেন।  সেই  থেকে ওই নারী বাংলা সনের চৈত্র মাসের ১০ দিন থাকতে স্নান শুরু করেন। এই স্নান করানো হতো রাতে। সেই সময় একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি রাতের স্নানের সময় তাকে অশ্লীল ভাষায় কথা বলতো।

ব্রিটিশ আমলের জমিদাররা ওই দেবতার নামে জমি দান করেন। ওই জমির ওপর মন্দির ও  মেলার স্থান নির্ধারণ হয়। মন্দিরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান  চেয়ারম্যানকে প্রেসিডেন্ট বলা হতো)  প্রেমচরণ মহাত্মা,  লোকনাথ বালো ও কাঙাল  গোসাঁই নিয়ম করেন,  বৈশাখের ২ তারিখে নিমাইচাঁদের স্নান হবে। সেই  থেকে পর্যায়ক্রমে তুলশি বালো, আদ্যনাথ বালো, পদ্মচরণ বালো, কৃষ্ণকুমার বালো, মাখন চন্দ্র রায়, ভজন বালো, রসিক লাল বালো,  ভোলানাথ রায় একইভাবে কাজ করে আসছেন।

সেই থেকে পর্যায়ক্রমে শুরু হয়ে আসছে নিমাইচাঁদের মেলা এবং কালিগঙ্গা নদীতে ২  বৈশাখ শুরু হয় নিমাইচাঁদের স্নান। এ স্নান সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে পবিত্র স্নান হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। 

 

আমার বার্তা/রতন বালো/এমই