যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের উদ্যোক্তাসহ সব অংশীজনরা। আগস্টের শুরুতে শুল্ক কার্যকরের সময়সীমার পূর্বে প্রতিদ্বন্দ্বী কোন দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের চেয়ে কম শুল্ক আদায় করে নিতে পারে তাহলে তা আরও উদ্বেগের কারণ হবে, বলছেন ব্যবসায়ীরা। মধ্যবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় সমাধানে আসতে বেশ কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন তারা।
হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে যে ট্যারিফ ইমব্যালান্স আছে সেটি যদি ফুলফিলের প্রস্তাব দেয়া হয় তাহলে এখনো দরকষাকষিতে ইতিবাচক পরিস্থিতির সুযোগ রয়েছে। আমরা তুলা আমদানি করি, লোহার স্ক্র্যাব আমদানি করি, এলএনজি নিয়ে আসি; কয়েকটা ক্ষেত্রে যদি ট্যারিফ জিরো করে দিই তাহলে আমাদের ট্রেডও বাড়বে এবং যে ইমব্যালেন্স আছে সেটাও পর্যায়ক্রমে কমে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মোট ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করি, এর মধ্যে গার্মেন্টসই ৬ বিলিয়ন ডলারের। কাজেই প্রেক্ষাপটগুলো তাদের বোঝানো সম্ভব। পাশাপাশি আমরা প্রস্তাব দিতে পারি যে আমাদের এখানে ওয়্যারহাউজ হবে মিরসরাইয়ে। সেখানে আমরা কয়েকশ একরের একটি জমি দেব। ওরা সেখানে ওয়্যারহাউজ করবে, সেখানে তাদের তুলা থাকবে। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোয়ও রফতানি করতে পারবে। বিভিন্ন প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেয়ার কথা। যদি কনভিন্স করতে পারে তাহলে আমার মনে হয় ডিউটিটা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা যাবে।’
ইন্দোনেশিয়া আগের থেকেই ওদের ব্যবসায়ী গ্রুপকে নিয়ে গিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করেছে উল্লেখ করে এ কে আজাদ বলেন, ‘আমরা লবিস্ট নিয়োগ করতে পারতাম, তারা তাদের গাইড করতে পারত। এসব জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি মনে হয়। আমি মনে করি একটা দেশ ওরা শেষ করে দেবে না। যেমন আমাদের এখন আছে ১৮ শতাংশ ডিউটি। তার ওপর যদি আরো অন্যান্য শুল্ক যোগ করা হয় তাহলে কোনোভাবেই ইফেক্টিভ হবে না। কেউ পণ্যই কিনবে না। এজন্য আরোপিত শুল্ক অবাস্তব। ভিয়েতনাম যেমন সমঝোতায় এসেছে, আমাদেরও তেমন হওয়া উচিত।’
স্কয়ার গ্রুপের পরিচালকও বিটিএমএ’র সাবেক সভাপতি তপন চৌধুরী বলেছেন, ‘অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় ভিয়েতনাম এক্ষেত্রে অনেক প্রোঅ্যাকটিভ ভূমিকা রাখতে পেরেছে। আমরা এখনো আশাবাদী। প্রধান উপদেষ্টা নিজে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হলেও যদি কথা বলেন তাহলে কাজ হবে বলে আমি মনে করি। আজ যে বৈঠক হবে সেখানেও আলোচনা হবে। তার পরও প্রধান উপদেষ্টা নিজে ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি ফোনে যদি কথা বলেন তাহলে কার্যকর কোনো কিছু হতে পারে বলে আমি মনে করি।’
‘আমাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির কোনো যৌক্তিকতা নেই, কারণ আমরা কোনো রেসিপ্রোকল পদক্ষেপ নিইনি। বাজেটেও বিশেষ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কাজ করি। যে কারখানাগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল তারা বড় ধরনের বিপদে পড়বে। আর যারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেশি দামের পণ্য বিক্রি করে তারা আরো বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এসব নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে এবং দরকষাকষিতে কার্যকর ফলাফল পেতে প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলবেন বলে প্রত্যাশা করছি’-বলেন তপন চৌধুরী।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘ট্রাম্পের ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে বলা হচ্ছে এখনো আরো নেগোসিয়েশনের সময় আছে। ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় আছে, দেখা যাক। প্রিম্যাচিউর অবস্থায় কিছু বলার প্রয়োজন দেখছি না। আমরা ফলো করছি এটা, দেখা যাক কী হয়। দরকষাকষির প্রস্তুতির সময় বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। প্রস্তুতি মূলত মন্ত্রণালয় ও সরকারের মধ্যেই ছিল। আর বাইরে উনারা কতটুকু কী করেছেন আমি জানি না। রাজনীতিতে যারা ইকোনমি নিয়ে কাজ করছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলে বোধ হয় ভালোই হতো। আলোচনা করলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। আলোচনাটা সেভাবে করা হয়নি। আমরা অন্তত আলোচনার অংশ ছিলাম না এটা বলতে পারব।’
বিষয়টি দেশের জন্য অনেক বড় ইস্যু উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, ‘জনগণের জীবন-জীবিকা, আমাদের রফতানির এতগুলো লোকের চাকরি, কর্মসংস্থান এ চুক্তির মধ্যে জড়িয়ে আছে। এটা শুধু গার্মেন্টস না, সবকিছুর বেলায় প্রযোজ্য। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও অনেক বড় বিষয়। এটা দেশের স্বার্থ, কোনো সরকারের স্বার্থ বা দলীয় ব্যাপার না। আলোচনার মাধ্যমে অনেক সময় অনেক কিছু বেরিয়ে আসে। এত বড় একটা বিষয় হাতছাড়া হয়ে গেলে তো আমাদের বিপদ হবে।’
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সরকারপ্রধান যেহেতু বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আলোচনা করতে হবে। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কাজেই সেই পর্যন্ত দর-কষাকষি করতে হবে। যাতে ভিয়েতনামের কাছাকাছি যাওয়া যায়। ভিয়েতনামও হয়তো দর-কষাকষি করে এই পর্যায়ে এসেছে। তাই আমাদের সরকারকেও সেভাবে এগোতে হবে। তা না হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় ঝুঁকিতে পড়বে দেশ।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। ফলে বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে আরও ৩৫ শতাংশ যোগ হয়ে ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যে মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত ব্যাপক প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইতোমধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে, যার আওতায় তাদের পণ্যে মাত্র ২০ শতাংশ শুল্ক বসবে। অর্থাৎ আমাদের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ শুল্ক থাকছে, যা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন করে তুলবে। যদি প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো দেশ এমন সুবিধা বাগিয়ে নেয়, তা আরও বড় সমস্যা তৈরি করবে’
‘আমরা কেন ভিয়েতনামের মতো সমঝোতা করতে পারলাম না? এর সুনির্দিষ্ট উত্তর সরকারের কাছেই আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত সমঝোতার খসড়া গোপন রাখার শর্ত ছিল। তবে চাইলে সরকার একটি ‘সমঝোতা দল’ গঠন করে বিষয়টি নিয়ে পেশাদার ও অংশগ্রহণমূলক আলোচনা করতে পারত’ বলেন ড. মোস্তাফিজ।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। তারা এমন জটিল ও কঠিন শর্ত দিল, যা পূরণ করা সম্ভব নয়। যেটা ভিয়েতনামে দেওয়া হয়েছিল। তারা পূরণ করতে পারলেও আমরা সেই কঠিন শর্ত পূরণ করতে পারব না। চীন, পাকিস্তানসহ যারা প্রতিযোগিতামূলক বাজার দখল করে আছে, তাদেরও দেখতে হবে। ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। এখনো মাঝে কিছুদিন সময় আছে। এই সময় কাজে লাগাতে হবে।’
আমার বার্তা/জেএইচ