লতিফা মঞ্জিলের মোসাম্মৎ লতিফা বেগম অকস্মাৎ একদিন আমাকে মৃত ঘোষণা করে বসলেন! রবীন্দ্রনাথের সুরবালা জুটির মতো একসঙ্গে আমরা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো পাঠশালায় যাইনি সত্য, কিন্তু প্রকৃতির পাঠশালায় আমাদের যুগল মূর্তির উপস্থিতি ছিল বেশ সরব। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষ তলে সবুজ অন্ধকারের স্বরূপ অন্বেষণে আমরা দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়েছি। বিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও সংসদ ভবনের সবুজ চত্বরের ঘাসের ডগা দিয়ে নাকফুল বানানোর মতো জটিল প্রযুক্তির রুদ্ধ বাতায়ন উন্মোচন করার গৌরব অর্জন করেছি; আর সে গৌরবে গরবিনি হয়ে ঘাস-নির্মিত নাকফুলে সজ্জিত লতিফা বেগম বলেছেন, ‘হবে মফিজ, তোমার হবে!’
রমনা পার্কের কদমতলায় বসে নিজে যদিও বাঁশি বাজাইনি, তবে ক্যাসেটে ধারণকৃত বাঁশির সুর শুনিয়েছি ওকে। সেই সুরের পরশে বেণি-বন্ধ লতিফা বেগম এলোকেশীতে রূপান্তরিত হয়ে গেয়ে উঠেছেন, ‘বংশী বাজায় কে রে সখী, বংশী বাজায় কে!’ বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়েছি আমরা প্রজাপতির ছন্দময় পাখা দোলানো দেখতে। রাজেন্দ্রপুরের অরণ্যে গিয়েছি ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হওয়ার আকুলতায় আমি আমার টিউশনিলব্ধ অর্থ ছাড়াও বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করেছি, বাবার পকেট সাফাই করেছি, বড় ভাইয়ের কাছে হাত পেতেছি, এমনকি ভাবির বাজারের টাকায় সুকৌশলে ভাগ বসিয়েছি। শিক্ষার মতো মৌলিক একটা বিষয়ে টাকা খরচ করতে আমার বিন্দুমাত্র কার্পণ্য ছিল না। অথচ কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি, লতিফা বেগম তার জীবন-সংসদের কার্যপ্রণালী থেকে আচমকা আমাকে এক্সপাঞ্জ অর্থাৎ মৃত ঘোষণা করে দিলেন! ‘মফিজ-কট’ হওয়ার পর যতবার লতিফা বেগমের নাম্বারে ফোন করেছি ততবারই উত্তর এসেছে, ‘নেই!’ পূর্বে একদিন ফোন করলেই লতিফা বেগম হাহাকার করে উঠতেন, ‘হায় মফিজ, আমার পৃথিবী থমকে ছিল গতকাল।’ লতিফা বেগমের ‘পৃথিবী’ এখন কেমন আছে তা জানার বাসনা আমাকে পেয়ে বসে এবং এজন্য আমাকে ইলিয়াস নামে আমার এক বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হয়। যে ইতোমধ্যে শখের থিয়েটারে সখী সেজে প্রচুর হাততালি পেয়েছে। বান্ধবীরূপী ইলিয়াসের ফাঁদে লতিফা বেগম পা দিতেই রিসিভারের দখল নিই আমি, ‘হ্যালো, লতিফা!’
‘ও, তুমি!’
‘হ্যাঁ লতি, আমি!’
‘আরে কাঁদছ কেন, কান্নার কী হলো?’
‘আর কেউ কাঁদে না বলে!’
‘মানে?’
‘মানে হলো, যখন কেউ মারা যায় তখন তার নিকটজনরা কান্নাকাটি করে। আমার বেলায় এমনটি ঘটেনি তো, তাই নিজের কান্না নিজেই কাঁদছি।’
‘ইন্টারেস্টিং! কিন্তু তুমি মারা গেলে কবে? কই শুনিনি তো!’
‘কেন, গত মাসের সতের তারিখে হাজী কোরবান আলীর আমেরিকা ফেরত ছেলে ইরফান আলীর সঙ্গে যখন চাইনিজ খেতে...!’
‘এটাকে তুমি মরে যাওয়া বলছ?’
‘এরপরও আমি বেঁচে আছি বলতে চাও?’
‘মফিজ! আমাকে রাখতে হচ্ছে। ঘরে একগাদা মেহমান।’
‘প্লিজ লতু! ফোন রেখো না।’
‘কী যন্ত্রণা!’
‘একথা তুমি বলতে পারলে লতি? আমি তোমাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন...!’
‘স্বপ্ন? প্রতিদিনই দেখো নাকি?’
‘দিনের স্বপ্ন তো আছেই; রাতেও স্বপ্ন দেখি। এই তো গত রাতেই দেখলাম। দেখলাম তুমি আর আমি দু’জন দু’জনের হাত ধরে আকাশ ভ্রমণে বের হয়েছি।’
‘বলো কী! কিসে করে?’
‘কোনো কিছুতে করে না।’
‘তবে?’
‘পাখায় করে।’
‘পাখা?’
‘হ্যাঁ পাখা। স্বপ্নে দেখি তোমার পিঠে দু’টো পাখা গজিয়েছে আর আমার পিঠেও দুটো পাখা গজিয়েছে।’
‘দারুণ তো! তারপর?’
‘পরেরটা আরও দারুণ। উড়তে উড়তে আমরা যখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ আমার একটি পাখা ভেঙে সাগরের পানিতে পড়ে গেল। একটু পরে অন্যটিও।’
‘সর্বনাশ! তুমি নিশ্চয়ই অতল সমুদ্রে...!’
‘না না, তুমি ছিলে না পাশে? তুমি এসে আমাকে ধরে প্রথমে বললে, আমার একটি পাখা তুমি নাও মফিজ। পরে বললে, কিন্তু এক পাখা দিয়ে তো উড়া যাবে না। তার চেয়ে এসো আমরা দু’জন এক সত্তায় লীন হয়ে যাই, আর আমাদের দু’জনের উড়বার মাধ্যম হোক অবশিষ্ট এই দু’টি পাখা।’
‘তোমার স্বপ্নে দেখছি বাস্তবতার ছোঁয়া আছে প্রচুর!’
‘সত্যি?’ ‘হ্যাঁ, আগামী মাসের ছাব্বিশ তারিখ রাতে আকাশে উড়ব আমি! আমেরিকা চলে যাচ্ছি!’
‘কার সাথে?’
‘হাজী কোরবান আলীর একমাত্র ছেলে ইরফান আলীর সাথে।’