প্রাণঘাতী করোনার ছোবলে যেমন অনেকে হারিয়েছে নিকটআত্মীয় ও স্বজন তেমনি অনেকে সবকিছু হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত। করোনা মহামারীর কারণে অনেকের জীবন-মানেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। কারও কারও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফুটপাতের হকার তথা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কেননা করোনার কারণে সরকার দেশব্যাপী লকডাউন দিয়েছেন। আবার কখনো কখনো লকডাউন উঠে গেলেও ছিল চলাচল ও দোকানপাট খোলা রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা। আর এক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন রাজধানীর ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেই কাজ হারিয়ে রাজধানী ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
এমনই একজন হলেন কারওয়ান বাজারের পথব্যবসায়ী নাজমুল আলম। করোনার আগে তার ছিল ভালো ব্যবসা। দিন পার হচ্ছিল আনন্দের সাথেই। দুই শিশু নিয়ে রাজধানীতে তার দিন কাটছিল ভালোই। কিন্তু দুঃখের বিষয় নাজমুল বর্তমানে ঢাকায় থাকলেও পরিবার তার সাথে নেই। কারণ করোনার কারণে তার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তাই পরিবারকে গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। তাই কষ্ট বুকে নিয়ে চলছে তার জীবন।
“আরে ভাই কি কমু। দুইডা মাইয়ারে কতদিন যে দেখি না। ইনকাম নাই, বাড়িতেও যাইতে পারি না। করোনার কারণে ভালো মোবাইলটাও বেইচা দিছি। তাই ওদের মুখটাও দেখতে পারি না।”
কথা হয় পল্টনের আরেক হকার শরিফুলের সাথে। করোনার প্রথম ধাক্কা আসে ২০২০ সালে। তখন তার ছিল রমরমা ব্যাগ ও জামা-কাপড়ের ব্যবসা। কিন্তু এখন মানুষের আয় কমে গেছে। তাই মানুষ এখন খরচও খুব একটা করে না। এজন্য তার ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। আগে যেখানে দিনে বেঁচতেন কয়েক হাজার টাকা, এখন সেটা নেমে এসেছে কয়েকশ’তে। কোনো কোনো দিন দোকান বসানোর ভাড়ার টাকাও উঠে না বলে জানান তিনি।
“ভাই আগে থাকতাম নয় তলায়। আর এহন থাহি বস্তির ধুপড়ি ঘরে। কারণ আয়-রোজগার নাই। কষ্টের কথা কি কমু। আমি তবুও বেঁচে আছি। কত মানুষ যে ঢাকা ছাড়ল,” এভাবেই আক্ষেপের সুরে বলছিলেন শরিফুল।
ফার্মগেটের পেয়ারা বিক্রেতা সুমনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “ব্যবসা ভালোই চলছে। তবে মাঝে করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ করে বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। বর্তমানে করোনার অবস্থা কিছুটা ভালো তাই এখন ব্যবসাও মোটামুটি ভালো যাচ্ছে। লকডাউনের সময় সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। সরকার অনেক অনুদান দিয়েছে। কিন্তু তা পরিমাণে যথেষ্ট না। কারণ আমার মতো অনেকেরই কাজ বন্ধ হয়ে ইনকামের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেকে আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছেন। অনেকে ঢাকায়ই ফেরেননি।”
এ বিষয়ে কবিও সহকারী অধ্যাপক, সমাজকল্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তৌহিদুল হক বলেন,“সত্যিই বলেছেন অনেক মানুষ এতে ঢাকা ছেড়েছেন। তিলোত্তমা ঢাকার রঙ ও জৌলুস কমেছে।”
সমাজে ভয়ের প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন,“এতে বৈষম্য বেড়ে গেছে। চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে গেছে। অনেকে গ্রামে গিয়ে লজ্জায়ও কিছু করতে পারছিলেন না, যা সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ”
কান্ট্রি ইকনোমিস্ট ইউএনডিপি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. নানজীন
আহমেদের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন,“যদিও দেশের এ সংকটকালে সরকার অনেক অনুদান দিয়েছে। কিন্তু এসব দিন-মজুর ও খেটে খাওয়া মানুষদের কেউ খবর নেয়নি। অনেক প্রকল্প-প্রজেক্ট নেয়া হলেও সঠিকভাবে বণ্টন না হওয়ায় অনেকের তা পাননি। সরকারকে এদিকে আরো নজর দেয়ার কথা বলেন তিনি। নতুন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে স্কোপে লাভ হবে না।”