সোমেশ্বরী, সুরমা আর পুরাতন সুরমা নদীর কিছু পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে উঠে গেছে। এতে নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল ডুবে গিয়ে সাময়িক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এতে লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার কিছু এলাকায় স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিপৎসীমায় ওঠানামা করছে তিস্তার পানি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা পার্থ প্রতিম বড়ুয়া বলেন, আমরা যে পূর্বাভাস দিয়েছি তাতে আর বৃষ্টি যদি না বাড়ে তাহলে এসব এলাকার বন্যা পরিস্থিতি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উন্নতি ঘটবে। তবে বৃষ্টি বাড়লে আরও কিছু এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়তে পারে।
কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে, অপরদিকে পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ওই নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুশিয়ারা, মনু-খোয়াই ছাড়া প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি বাড়ছে। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার চলমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও আশপাশের উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসায় পরবর্তীতে চলমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে এবং লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
কেন্দ্র জানায়, তাদের পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশন আছে ১০৯টি। এরমধ্যে পানি বেড়েছে ৭৩টি স্টেশনের, কমেছে ৩৫টির, আর অপরিবর্তিত আছে একটির। এদিকে বিপদসীমার ওপরে উঠেছে তিনটি স্টেশনের পানি, এতে বন্যা কবলিত হয়েছে দুই জেলা।
গত ২৩ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে সিলেটে ৩১৫ মিলিমিটার। এছাড়া জাফলংয়ে ২৪৫, পঞ্চগড়ে ২৩০, ছাতকে ২১৮, জারিয়াজাঞ্জাইলে ১৭৫, সুনামগঞ্জে ১৭০, লালাখালে ১৫১, দুর্গাপুরে ১০৯, গাইবান্ধায় ১০২, রোহানপুরে ৯২, মহেশখালীতে ৯০, কানাইঘাটে ৭৮, সিরাজগঞ্জ ও দিনাজপুরে ৬০ এবং ডালিয়া পয়েন্টে ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।
নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে, কলমাকান্দা উপজেলার বাহাদুরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাইজপাড়া, খলা-২, বড়খাপন, চৌহাট্টা, বাউসারী, হাইলাটী, রিকা, পোগলা, ভাটিপাড়াসহ প্রায় ৬০টি বিদ্যালয়ের মাঠে পানি ঢুকেছে এবং উপজেলা মোড়-মুক্তিরচর, বাহাদুরকান্দা-বাসাউড়া, ঘোষপাড়া, হরিণধারা, কলমাকান্দা-বিশরপাশা পাকা রাস্তা, গোরস্থান-সাউদপাড়া, গজারমারী-খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদ, গোবিন্দপুর-রানীগাঁও কাঁচা রাস্তাসহ আরও অন্তত ১০টি রাস্তার বিভিন্ন অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানান।
কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুল হক বলেন, আমার ইউনিয়নের তিনটি সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে এবং কলমাকান্দা-গোবিন্দপুর সড়কের বাউসাম রুমালীর বাড়ি সংলগ্ন এলাকার সড়কটির কিছু অংশ পানিতে ভেঙে যাওয়ায় ভাঙা অংশের মেরামতের কাজ চলছে।
পোগলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, পানি বাড়তে থাকায় ইউনিয়নের কালাকোনা, জীবনপুর, গোয়াতলা, কৈলাটি, মঙ্গলসিধসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। এতে ওই এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
কলমাকান্দা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জাহানারা খাতুন বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় কতগুলো বিদ্যালয়ে বন্যার পানি এসেছে তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে বাহাদুরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাইজপাড়া, খলা-২, বড়খাপন, চৌহাট্টা, বাউসারী, হাইলাটী, রিকা, পোগলা, ভাটিপাড়াসহ বেশ কিছু বিদ্যালয় মাঠে পানি ঢুকেছে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে খোঁজ-খবর নিচ্ছি এবং জরুরি সেবা নম্বর খোলা হয়েছে। শুকনো খাবারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে এবং কলমাকান্দায় উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্ব ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে নেত্রকোণার নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার সৃষ্টি হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গতকাল সোমবার সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ স্টেশনে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে ৭.৯৬ মিটারে প্রবাহিত হয়েছে। বেলা ১২টায় ৩ সেন্টিমিটার বেড়ে ৭.৯৯ মিটার সমতলে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপরে। জেলায় গত কয়েকদিনে মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বছরের সর্বোচ্চ ৩৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে গতকাল। আজও সুনামগঞ্জে ১৭০ মিলিমিটার এবং ছাতকে ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে স্বল্পমেয়াদী বন্যার আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্ভাবাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পূর্বাভাসে জানানো হয়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানি সমতল স্থিতিশীল আছে। তবে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে এবং লালমনিরহাট ও নীলফামারি জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
পাউবো জানায়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুশিয়ারা, মনু-খোয়াই ব্যতীত প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার চলমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে। আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসায় পরবর্তী সময়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
এবি/ওজি