
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন আর লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ মিঠাপানির উৎসকে ক্রমেই ঝুঁকির মুখে ফেলছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অগভীর মিঠাপানির প্রাপ্যতা আরও কমিয়ে দিয়েছে আর্সেনিক দূষণ। তবে আশার বিষয় হলো, উপকূলীয় অঞ্চলে মাটির আরও গভীরে মিঠা পানির বিশাল ভান্ডারের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
উপকূলীয় এলাকায় ভূপৃষ্ঠের অগভীর স্তরের বেশির ভাগ পানি লবণাক্ত। আর গভীর স্তরে মিঠাপানির যে মজুত রয়েছে, তার পরিমাণ এখনো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলাম্বিয়া, নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড টেকনোলজি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিপ ব্লু জিওফিজিক্স এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় পশুর নদীর তীর বরাবর মাটির গভীরে মিঠা পানির মজুত খুঁজতে শুরু করেন।
বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত নিবন্ধে গবেষকেরা বলেছেন, তাঁরা গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের পশুর নদীর তীর বরাবর গভীর ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্য ম্যাগনেটোটেলুরিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতিতে মিঠা ও নোনা পানির মধ্যে বৈদ্যুতিক রোধের যে তফাৎ থাকে, তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
সংগৃহীত তথ্যচিত্রে দেখা গেছে, ভূগর্ভের গভীরে দুটি পৃথক মিঠাপানির আধার রয়েছে, আর এ দুটির মাঝখানে রয়েছে উচ্চ লবণাক্ত একটি অঞ্চল। গবেষকেরা লিখেছেন, আমরা মনে করি—শেষ বরফযুগের সর্বোচ্চ বরফাবরণকালে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ অনেক নিচু ছিল, তখনই এসব গভীর মিঠাপানির আধার তৈরি হয়। এরপর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ওপরের সূক্ষ্ম দানার পলিমাটি এই পানির স্তরকে ঢেকে নিচে ফেলে, তবে এগুলো এখনো সুরক্ষিত আছে। বিপরীতে গঙ্গার প্রাচীন প্রবাহের দুই পাশের এলাকা, পরবর্তীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা ভূখণ্ডের দিকে আরও এগিয়ে আসা এবং নতুন পলিমাটির সঞ্চয়ই মাঝের লবণাক্ত অঞ্চলের জন্ম দিয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, তাঁরা যে, পানির মজুতের কথা বলছেন, তা ৯০ মিটার থেকে ১০০ মিটার গভীরে পাওয়া যেতে পারে। তাঁদের ধারণা, এই অ্যাকুইফারগুলো বা ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলো সম্ভবত প্লাইস্টোসিন বা আরও পুরোনো কালে তৈরি হয়েছিল। তাঁরা বলছেন, আমাদের ধারণা, এই দুই মিঠাপানির আধার, যা শেষ বরফযুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ আরও নিচে থাকার সময় তৈরি হয়েছিল। এরপর পলিমাটির সূক্ষ্ম দানার কম-প্রবেশযোগ্য স্তর এগুলোকে সিল (প্রায় অপ্রবেশযোগ্য স্তর) করে দেয়। সর্বশেষ বরফযুগে এসব জলাধার বর্তমান সময়ের সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে প্রায় ১২০ মিটার নিচে ছিল।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এই দুটি জলাধার আসলে শেষ বরফযুগে সমুদ্রপৃষ্ঠ আরও নিচে থাকার সময় গঠিত মিঠাপানির আধার। সেই সময় উপকূলরেখা ছিল অনেক দূরে। এরপর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে থাকলে সূক্ষ্ম দানার পলি পড়ে অ্যাকুইফারগুলো ঢেকে যায়। এর সঙ্গে তৈরি হয় অপ্রবেশযোগ্য কাদামাটির স্তর। যার ফলে, এসব অ্যাকুইফার বা জলাধারগুলোতে ওপরের লবণাক্ত পানি নিচে ঢুকতে বাধা পায়। ফলে ভূগর্ভের গভীরে মিঠাপানির স্তরগুলো হাজার হাজার বছর ধরে অক্ষত আছে।
আমার বার্তা/এমই

