ঢাকা একসময় প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হলেও এখন অতি নগরায়ণের কারণে ঢাকায় উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানের গতি মন্থর হয়ে গেছে। তাই এখন প্রবৃদ্ধির জন্য নতুন শহরকে বেছে নিতে হবে। তা না হলে পরবর্তী ধাপের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান গড়ে ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। কিন্তু ২০১৭ থেকে ২০২২ সালে তা কমে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি শিল্প কর্মসংস্থান নেতিবাচক ধারায় নেমে গেছে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) পক্ষ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত ‘নগরায়ণ এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন’ শীর্ষক সেমিনারে গবেষণায় প্রাপ্ত এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর বনানীর পিআরআই কার্যালয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সেমিনারে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশের বেশি একটি শহরে বসবাস করলে সেই শহরে মাথাপিছু আয় কমে যায়। বৃহত্তর ঢাকায় এখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশের বাস। ঢাকার এমন অতিকেন্দ্রিকতার কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির প্রায় ৬ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। ঢাকায় সুযোগ কমে আসায় এখন ঢাকার বাইরে কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু তা অপরিকল্পিতভাবে। এই অপরিকল্পিত উন্নয়ন থামিয়ে পরিকল্পিত নগরায়ণ দরকার। সে জন্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও খুলনার বাইপাস এবং কুমিল্লা নতুন বিকল্প হতে পারে।
পিআরআই আয়োজিত এই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন। সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক খুরশীদ আলম। আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির পরিচালক আহমদ আহসান।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, অগ্রসর অর্থনীতির দেশে প্রতি হাজার মানুষের জন্য সাত একর খোলা জায়গা থাকে। কিন্তু ঢাকায় খোলা জায়গা নেই বললেই চলে। খুলনায় এটা দুই একর করার পরিকল্পনা রয়েছে। আরও কিছু শহরে এটা নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এদিকে এখানকার পৌরসভাগুলোতে কোনো পারফরম্যান্স মনিটিরং নেই। ৪০টি সংস্থার আওতায় তাদের কাজ করতে হয়।
সেমিনার শেষে এ বিষয়ে আহমদ আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দশকে যেভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম হয়েছে, তাতে জিডিপির বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এই উন্নয়ন যদি অন্য শহরে ছড়িয়ে দেওয়া যেত, তাহলে জিডিপি আরও বাড়ত। আগামী পাঁচ–ছয় বছরে নতুন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সরকারের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ছিল অর্থের অপচয়। কারণ, চীনে একটি দিয়ে শুরু হয়ে পরে তা চারটিতে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে শুরুতে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে ফোকাস নষ্ট করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে জমি ব্যবস্থাপনার বড় গবেষণাকেন্দ্র হতে পারে জেনেভা ক্যাম্প। সেখানে খুব অল্প জমির মধ্যে সবকিছু করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণকে জোরদার করতে হলে স্থানীয় সরকারকে শুধু দায়িত্ব দিলে হবে না, ক্ষমতাও দিতে হবে
হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান,পিপিআরসি
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ঢাকার মতো বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংকক ও সিউলের মতো বড় শহর আছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঢাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো শহর নেই, এটাই সমস্যা।
চট্টগ্রামও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আগে রেলওয়ে ও নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ছিল। কিন্তু নীতি কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সেগুলো সরিয়ে আনা হয়েছে। আগে মফস্সল এলাকার ভিত্তি ছিল জেলা স্কুল। এখন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও নিজের গ্রামে থাকেন না, তাহলে সেখানে ভালো স্কুল কীভাবে গড়ে উঠবে, এই প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বাংলাদেশে জমির স্বল্পতা থাকলেও পরিকল্পনাবিদদের মাথাটা জমিদারদের মতো বলে মন্তব্য করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিলেই বলা হয়, ১০০ একর জমি লাগবে। সচিবদের জন্য পাঁচ হাজার বর্গফুটের বাসা বানানো হয়। অথচ জাপানেও এ সবকিছু অনেক ছোট করে বানানো হয়। ভবিষ্যতে জমি ব্যবস্থাপনার বড় গবেষণাকেন্দ্র হতে পারে জেনেভা ক্যাম্প। সেখানে খুব অল্প জমির মধ্যে সবকিছু করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণকে জোরদার করতে হলে স্থানীয় সরকারকে শুধু দায়িত্ব দিলে হবে না, ক্ষমতাও দিতে হবে।
নগরায়ণের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আলাপ ঐকমত্য কমিশনসহ কোনো টেবিলেই আনা হচ্ছে না।
সভাপতির বক্তব্যে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক খুরশীদ আলম বলেন, পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে গুলশান–বনানী বড় হতে থাকে, শ্রমিক বাড়তে থাকে, ঘনত্ব বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে গাজীপুর–নরসিংদীতে জমি পাওয়া সহজ হওয়ায় কারখানা সেদিকে চলে যায়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এবং কালুরঘাট একসময় শিল্প এলাকা ছিল, এখন সব ঢাকামুখী। এখানেই ব্যাংকের সব শাখা। বিদেশিরাও এখানেই আসে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, দেশে একটিমাত্র বড় শহর থাকায় সে শহরে জীবনযাত্রাসহ ব্যবসা–বাণিজ্যের ব্যয় বাড়ছে। দেশের দ্বিতীয় কোনো শহর ঢাকার মতো সুযোগ–সুবিধা দিতে পারছে না, নাকি ঢাকায় ব্যবসা করা সহজ বলে সবাই ঢাকামুখী—সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।
সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকায় এখনো ব্যবসার খরচ সবচেয়ে কম বলে জানান বাংলা কেমিক্যাল নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এম এম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, সুযোগ–সুবিধার অভাবে ব্যবসায়ীরা নতুন শহরে যেতে চান না। উদ্যোক্তারা কেউ গাজীপুরে থাকেন না, থাকেন কর্মজীবীরা। এমনকি গ্রামের লোকেরাও উন্নত শিক্ষার জন্য জেলা শহরে চলে আসছেন।
পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন করপোরেশনগুলো তৈরি করা হয়েছিল। চট্টগ্রামের মেয়রকে পাশ কাটিয়ে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। একইভাবে গাজীপুর ও খুলনায় মেয়র পছন্দ না হওয়ায় এটা করা হয়েছিল। তবে ঢাকার বাইরে অনেক শহরে অন্যান্য সামাজিক সুবিধা নেই। যেমন ভোলায় ১৮ লাখ মানুষ থাকে, যা ভুটানের চেয়ে বেশি। কিন্তু সেখানে কোনো আইসিইউ নেই, লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে সবাই ঢাকামুখী।
আমার বার্তা/এল/এমই