
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বি/২০২৫ ব্যাচের নবীন নাবিকদের ২২ সপ্তাহব্যাপী বুটক্যাম্প প্রশিক্ষণের সফল সমাপ্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হলো বর্ণাঢ্য শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ। সোমবার (২৪ নভেম্বর ২০২৫) পটুয়াখালীর বানৌজা শের-ই-বাংলা প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত এ জমকালো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। তিনি প্যারেড পরিদর্শন ও সালাম গ্রহণ করেন এবং পরে প্রশিক্ষণে কৃতিত্ব অর্জনকারী নবীন নাবিকদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করেন।
কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী বি/২০২৫ ব্যাচের ৪১৭ জন নবীন নাবিক দীর্ঘ ও কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়। জাতীয় পতাকা স্পর্শ করে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও যেকোনো প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের শপথ গ্রহণ করে। নতুন নাবিকদের এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ছিল শৃঙ্খলা, বীরত্ব এবং দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অনন্য বাহার।
প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে রিজান মোল্যা ব্যাচের সেরা চৌকশ নাবিক নির্বাচিত হয়ে অর্জন করেন মর্যাদাপূর্ণ ‘নৌপ্রধান পদক’। মো. মারুফ হাসান মুন্না ‘কমখুল পদক’ এবং মো. হাসান আলী ‘শের-ই-বাংলা পদক’ অর্জনের মাধ্যমে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তাদের এই অসাধারণ অর্জনে উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান।
প্রধান অতিথি নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান নবীন নাবিকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে সর্বপ্রথম গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীর নৌকমান্ডোদের। তিনি জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী সকল শহিদকেও স্মরণ করেন। দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য তাদের ত্যাগের কথা উল্লেখ করে তিনি নবীন নাবিকদের অনুপ্রাণিত হওয়ার আহ্বান জানান।
নৌবাহিনীর প্রধান তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের সামনে থাকা অসীম সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরে নবীন নাবিকদের সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা থেকে শুরু করে নৌ-সীমায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গভীর সমুদ্রের সম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক অর্থনীতি উন্নয়ন—সকলক্ষেত্রে নৌবাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য ও ক্রমবর্ধমান। নতুন সদস্যদের এই দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হতে আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠার দিকনির্দেশনাও প্রদান করেন তিনি।
বিশ্বের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি ও জটিল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির গুরুত্ব উল্লেখ করে নৌপ্রধান বলেন, “আজকের নৌবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ত্রিমাত্রিক বাহিনী। সাগর, আকাশ ও পানির নিচে সমান দক্ষতায় কর্মকৌশল পরিচালনা করতে সক্ষম একটি আধুনিক নৌবাহিনী গঠনে প্রত্যেক সদস্যের নিষ্ঠা অত্যন্ত প্রয়োজন।” তিনি নবীন নাবিকদের প্রতি দেশের সংকটময় মুহূর্তে মানুষের জানমাল রক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা প্রদান এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব প্রদর্শনের আহ্বান জানান।
দেশসেবাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় নৌবাহিনী প্রধান নবীন নাবিকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আজকের এই নবীন নাবিকরাই ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমানা রক্ষা ও সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, “আপনারা শুধু নৌবাহিনীর সদস্য নন; আপনারাই নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বলিষ্ঠ সৈনিক।”
কুচকাওয়াজ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নৌবাহিনী সদর দপ্তরের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও)গণ, বিভিন্ন সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং নবীন নাবিকদের অভিভাবকরা। অনুষ্ঠানের প্রতিটি মুহূর্ত জুড়ে ছিল গর্ব ও আনুষ্ঠানিকতার আবহ, যা নবীন নাবিকদের জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়মিতভাবে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করে আধুনিক নৌবাহিনী হিসেবে দেশ রক্ষার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা মিশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
এই বর্ণাঢ্য সমাপনী প্যারেড নবীন নাবিকদের সামনে দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে, যা ভবিষ্যতে তাদেরকে এক দক্ষ, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও দেশপ্রেমিক নৌসদস্য হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

