জরুরি সেবা একটি রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। নাগরিকের বিপদের মুহূর্তে দ্রুততম সহায়তা পৌঁছে দেওয়া রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার অন্যতম প্রমাণ। অথচ বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই সেবা কখনো পৌঁছায় না, কখনো পৌঁছায় দেরিতে, আর অনেক সময় আসেই না। ফলশ্রুতিতে একটি অমূল্য জীবন শেষ নিঃশ্বাস ফেলে চিকিৎসা পাবার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে। একটুখানি দ্রুততায় যাকে বাঁচানো যেত, সে হারিয়ে যায় এক কলের ব্যর্থতায়, এক চালকের গাফিলতিতে কিংবা এক সিস্টেমের দুর্বলতায়।' ৯৯৯' জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর। বহুদিন ধরেই এ নম্বরটির ব্যাপক প্রচারণা চলছে "যেকোনো বিপদে কল করুন ৯৯৯ নম্বরে"এই আশ্বাসে যেন দেশের প্রতিটি নাগরিক এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ পেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। রাজধানীর বাইরে, বিশেষ করে উপজেলা ও গ্রামীণ পর্যায়ে, ৯৯৯ নম্বরে বারবার কল দিয়েও অনেকে সাড়া পান না। কখনো কল রিসিভ হয় না, কখনো অল্প কথার পর লাইনে ব্যাঘাত ঘটে, আবার কখনো অপারেটরের পক্ষ থেকে যথাযথ সহায়তা না পেয়ে হতাশ হতে হয়। এম্বুলেন্স সেবার ক্ষেত্রেও সংকট প্রকট।
রাজধানী ঢাকাতেও "স্মার্ট সিটি" হবার স্বপ্নে বিভোর প্রশাসনের সামনেই অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছাতে দেরি করে একাধিক কারণে। যানজট, লোকেশন বিভ্রাট, পর্যাপ্ত গাড়ি না থাকা কিংবা চালকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা তার ভেতরে অন্যতম কারণ। আর গ্রামের কথা যদি বলি সেখানে অনেক জায়গায় এখনো অ্যাম্বুলেন্স বলতে স্থানীয় মাইক্রোবাসই ভরসা, যা জরুরি চিকিৎসা পরিবহনের মানদণ্ড পূরণ করে না। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও আমাদের জরুরি সেবা এখনো আদিমতায় রয়ে গেছে। লোকেশন ট্র্যাকিং ব্যাবস্থা দুর্বল, অনেক সময় কলারের অবস্থান চিহ্নিত করতেই অপারেটররা ব্যর্থ হন। স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেটনির্ভর ব্যবস্থায়ও সঠিক সফটওয়্যার বা অ্যাপস ব্যবহারের উদ্যোগ এখনো সীমিত। যে দেশে ride-sharing অ্যাপে সেকেন্ডের মধ্যে গাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়, সেই দেশে একটানা দশ মিনিট ৯৯৯-এ ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে না পাওয়াটা কেবল দুঃখজনকই নয়, তা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার চরম প্রকাশ।
এই ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অভাব, দুর্বল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি। জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত অপারেটরদের অনেকেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। সংকটকালে কীভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কীভাবে মানুষকে মানসিকভাবে সহায়তা করতে হয় এসব বিষয়ে তেমন কোনো গাইডলাইন বা বাস্তবভিত্তিক ট্রেনিং নেই। একই সঙ্গে নেই পর্যাপ্ত মনিটরিং ব্যবস্থা, যেটি এই সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারত। তবে শুধু প্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। প্রয়োজন একে মানবিক ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থায় রূপান্তরের। একটি রাষ্ট্রীয় হেল্পলাইন চালু মানেই দায়িত্ব শেষ নয়, এটি যেন ২৪ ঘণ্টা কার্যকর, তৎপর এবং প্রতিক্রিয়াশীল থাকে, তা নিশ্চিত করাটাই মূল কর্তব্য। আর এক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ, সেবা প্রদানকারীদের প্রণোদনা এবং তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার একটি সমন্বিত কৌশলের অংশ হতে হবে। অন্যদিকে, জরুরি সেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
বহির্বিশ্বের অনেক দেশ সামান্য প্রযুক্তি দিয়েই স্থানীয় স্তরে কার্যকর রেসপন্স ইউনিট গড়ে তুলেছে। প্রতিটি থানায়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং পৌর এলাকায় তারা জরুরি সেবার জন্য নিজস্ব টিম রাখছে, যাদের হাতে রয়েছে একটানা প্রশিক্ষণ, দ্রুতগতির যানবাহন এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ। বাংলাদেশেও এই ধরনের স্থানীয় রেসপন্স ইউনিট গড়ে তোলা সম্ভব, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা থাকে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় জরুরি সেবা পৌঁছানোর একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা, প্রশিক্ষিত টিম এবং প্রযুক্তি নির্ভর মনিটরিং সিস্টেম জরুরি ভিত্তিতে চালু করা দরকার। আজ যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন জরুরি সেবা ব্যবস্থার এমন ধীরগতি সত্যিই বিব্রতকর। একটি প্রজাতন্ত্রের শক্তি তখনই প্রমাণিত হয়, যখন তার দুর্বলতম নাগরিককেও সঙ্কটে পরে একা লড়তে না হয়। কিন্তু ৯৯৯ নম্বর যে প্রতিটি নাগরিকের জন্য আস্থা হয়ে উঠবে, সেই স্বপ্ন এখনও অধরা। আর প্রতিবার যখন কেউ সময়মতো সহায়তা না পেয়ে প্রাণ হারায়, তখন রাষ্ট্র তার এক মৌলিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। এখন সময় এসেছে এই প্রতিশ্রুতি পূরণের। জরুরি সেবা ব্যবস্থার প্রতিটা স্তর থেকে আমল পরিবর্তন প্রয়োজন। কেবল বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়, বাস্তব ব্যবস্থাপনার দৃঢ়তা দিয়েই এই ব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর করতে হবে। না হলে জরুরি সেবায় ধীরগতির ফলে প্রাণ যাবে হাজারো মানুষের। ভেসে যাবে পরিবারগুলো। আর এই প্রাণ রক্ষা না করতে পারার দায়ে রাষ্ট্রও সমানভাবে অপরাধী ।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।
আমার বার্তা/জেএইচ