দেশে পর্যটন খাতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে প্রশংসনীয় এক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে চলতি মাসেই কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে চালু হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। কক্সবাজার থেকে সরাসরি ফ্লাইট যাবে কলকাতায়।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের পরিচালক গোলাম মুর্তজা হোসেন জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই কক্সবাজার-কলকাতা ফ্লাইট চালু হবে। ইতোমধ্যে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনসহ প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে বিমানবন্দরটির অবস্থান। দেশে এই প্রথম কোন বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সমুদ্রের বুকের উপর। ১০ হাজার ৭০০ ফুট দীর্ঘ রানওয়ের মধ্যে ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে সাগরের ওপরে।
বেবিচক সূত্র মতে, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ৯১২ দশমিক ৪৯ বর্গফুট আয়তনের টার্মিনাল ভবনে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন ডেস্কও স্থাপন করার কাজ শেষ হয়েছে।
সিভিল এভিয়েশনের প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চালু করা হচ্ছে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তন্মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ২ হাজার ১৫ কোটি টাকা। রানওয়ে সম্প্রসারণ ব্যয় ৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে ২৭৭ কোটি টাকা।
বেবিচক সূত্র আরো জানায়, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ৩টি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। প্রথম প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০০৭ সালে, দ্বিতীয়টি ২০১৯ সালে এবং তৃতীয় প্রকল্পটি ২০১৯ সালে।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে ঘোষণা করলেও বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রাথমিকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা এ মাসে শুরু করলেও বিমানবন্দরটি পুরোপুরিভাবে চালু হতে আরো সময় লাগবে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ভোটের রাজনীতির কারণে ইতোপূর্বে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তড়িঘড়ি করে ২০১৭ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তখন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যে মানদণ্ড থাকার প্রয়োজন তার সিকিভাগও ছিল না। শুধু কক্সবাজারবাসীকে খুশি করার জন্য এ ধরনের ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে এবার সত্যি সত্যিই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হবে।
সিভিল এভিয়েশনের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, খুব দ্রুত কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে চালু হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে ঘোষণা করেছে। বলছে মাসের শেষ সপ্তাহে কক্সবাজার-কলকাতা সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে প্রাথমিকভাবে কক্সবাজার-কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। পর্যায়ক্রমে কক্সবাজার-জেদ্দা, কক্সবাজার-দুবাই এবং কক্সবাজার-মালয়েশিয়া ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালু হলে বিদেশি পর্যটকের আগমন বেড়ে যাবে। এতে করে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। বাড়বে অর্থনৈতিক আয়। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার বিদেশি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে তারা সহজেই কক্সবাজার আসতে পারবেন। এসব বিষয় মাথায় রেখে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যুগ্ম সচিব আহমেদ জামিলের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে গত রবিবার বলা হয়েছে, দ্য সিভিল এভিয়েশন রুলস ১৯৮৪-এর রুল ১৬-এর সাব রুল (১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে “কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর” হিসাবে ঘোষণা করেছে। জনস্বার্থে জারি করা এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হবে।
এদিকে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোঃ মোস্তফা মাহমুদ বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অথবা প্রয়োজনীয় কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে কাজ করছি। তিনি বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস পরিদর্শন করেছেন। সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে ঘোষণা করেছে। এ লক্ষ্যে সিভিল এভিয়েশন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি এ মাসেই কক্সবাজার-কলকাতা-কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারব।
যুদ্ধের বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
কক্সবাজার হলো দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্যটন নগরী। সমুদ্রের কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা কক্সবাজার শহরটিতে সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সমাগম ঘটে। আজকের এই কক্সবাজার বিমানবন্দরটির নির্মাণ করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধের ব্যবহারের জন্য কক্সবাজার বিমানবন্দর নির্মাণ করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কক্সবাজার বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এটি সংস্কার করে এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য চালু করে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিমানবন্দরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে পুনরায় বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা-কক্সবাজার-ঢাকা ফ্লাইট চালু হয়। পরবর্তীতে আবার ২০১২ সালে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট কক্সবাজার বিমানবন্দরে চলাচল বন্ধ হয়। তবে কার্গো ফ্লাইট চালু ছিল। সেই সাথে বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, নভো এয়ার, ইউএস বাংলাসহ কয়েকটি সংস্থা ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও প্রতিদিন তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে বর্তমানে বিমানবন্দরের অবকাঠামো অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সর্বশেষ চীনের দুইটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন-জেভি যৌথভাবে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে উন্নীত করতে অত্যাধুনিক রানওয়েসহ বিমানবন্দর অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।
সিভিল এভিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শীর্ষ হাব বানানো হবে। এ লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর পর সরকার ৪৮ ঘণ্টার ভিসা-অন-অ্যারাইভালের পরিকল্পনাও করেছে, যা পর্যটক বাড়াতে সহায়তা করবে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, শুরুর দিকে হয়তো ফ্লাইট সীমিত হবে। তবে পর্যায়ক্রমে এটি দেশের জন্য আকাশ পথের একটি বড় প্রবেশদ্বার হবে।
এদিকে স্থানীয় আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকার বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য দেশি কিংবা বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো থেকে ফ্লাইট পরিচালনার নিশ্চয়তা পায়নি। ফলে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়েছে বেবিচক। তাদের মতে, সরকার এখনো বৈশ্বিক পর্যায়ে কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারেনি। বিদেশি পর্যটকদের কাছে কক্সবাজারকে ও বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতকে যথাযথভাবে প্রচার করতে পারেনি। বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদন ও আকর্ষণ বাড়াতে পারেনি। সেই সাথে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়নি। এছাড়া বিমান সংস্থাগুলোর সাথেও এখন পর্যন্ত ইতিবাচক অর্থাৎ ফ্লাইট পরিচালনার নিশ্চয়তা সম্মতিও পাচ্ছে না বেবিচক।
পর্যটক কেন্দ্রীক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো জানিয়েছে, সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। ব্যবসায়ীরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে দীর্ঘ ৯ বছর আগে ৩টি ট্যুরিজম পার্ক করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগটি এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সরকার কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও মহেশখালী উপজেলায় প্রায় ১১ হাজার একর জমিতে বেজার ৩টি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবী। টেকনাফের সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের জন্য ৯৬৭ একর জমি, ২৭১ একর জমিতে নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমিতে সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক করার কথা রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট আসা-যাওয়া অনেক বেড়ে যাবে।
আমার বার্তা/এমই