জনগণের নেতৃত্বাধীন জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনাবিষয়ক জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার ১৭টি ওয়ার্ডের ১০৬টি স্বল্প-আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পানি ও স্যানিটেশন পরিষেবা সংক্রান্ত জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করা হয়।
সোমবার (২৮ এপ্রিল) ঢাকার লেকশোর হোটেলে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
জনগণের নেতৃত্বে প্রস্তুতকৃত এই অভিযোজন পরিকল্পনাটি ওয়াটারএইড বাংলাদেশ এবং দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) কর্তৃক পরিচালিত হয়েছে। এই প্রকল্পে সহায়তা করেছে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ) এবং যুক্তরাজ্য সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)। এই পরিকল্পনা বিশ্বব্যাংক-এর অর্থায়নে পরিচালিত চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পের (সিডাব্লিউএসআইপি) জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করবে।
জনগণের পরিকল্পনার ফলাফল উপস্থাপন, অংশীজনদের কাছ থেকে মতামত সংগ্রহ ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা এবং জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এই পরামর্শ সভাটি আয়োজিত হয়।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার বিভাগ, ব্রিটিশ হাইকমিশন, ঢাকা ওয়াসা, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ ৮০ জনেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন অংশগ্রহণ করেন।
স্থানীয় পর্যায়ে এই অভিযোজন পরিকল্পনা প্রনয়ণে তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধীনে জলবায়ু ঝুঁকির বৈজ্ঞানিক মূল্যায়নের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্পের (সিডাব্লিউএসআইপি) বিনিয়োগের জন্য তথ্য সরবরাহ করতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার অনুমোদনক্রমে গত বছরের জুন মাসে চট্টগ্রামে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এই পরিকল্পনার আওতায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট দুর্বলতা ও চাহিদা অনুসারে অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বিভিন্ন অংশীজন ও দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মূল্যবান মতামত অন্তর্ভুক্ত করে ওয়ার্ড ও মহানগর পর্যায়ে ধারাবাহিক পরামর্শের মাধ্যমে এই পরিকল্পনাসমূহের কঠোরভাবে যাচাইকরণ ও পরিমার্জন করা হয়েছে।
সভায় ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিজ হাসিন জাহান তার বক্তব্যে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন একটি চিরায়ত বাস্তবতা; এটি কোনো দূরবর্তী হুমকি নয়, তবে এর জটিলতা, দুর্বোধ্য শব্দসমূহে আবৃত থাকায়, প্রায়ই এটি সেইসব উদ্দিষ্ট মানুষদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, যাদের ওপর এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে। অভিযোজনকে অর্থবহ করতে হলে আমাদের জলবায়ু কার্যক্রমকে অভ্যন্তরীণকরণ করতে হবে, এটিকে জাতীয় পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং স্থানীয়ভাবে পাওয়া প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।”
ওয়াটারএইড এবং ডিএসকের সঙ্গে অংশীদারিত্বের প্রশংসা করে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন বাংলাদেশ কান্ট্রি ম্যানেজার ড. এম ফয়সাল রহমান উল্লেখ করেন যে, এলএলএ-এর গ্লোবাল হাবের মাধ্যমে জিসিএ তার অ্যাডাপ্টেশন অ্যাকসিলরেশন প্রোগ্রামের অধীনে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (আইএফআই)-এর বিনিয়োগের সঙ্গে জনগোষ্ঠী কর্তৃক প্রণীত জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনাসমূহকে সংযুক্ত করে এলএলএ-এর পরিধি বাড়াতে চায়।
তিনি আরও বলেন, “জনগণের পরিকল্পনার কিছু অংশ সিডাব্লিউএসআইপি প্রকল্প দ্বারা বাস্তবায়িত হলেও, আমি চট্টগ্রাম ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো সব নগর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব এই পরিকল্পনাসমূহকে আপনাদের বার্ষিক নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করবেন।”
স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, “আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী- আমাদের ভোগবাদী মানসিকতাই এর মূল কারণ। ওয়াশ সেক্টরে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমরা অনেক বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য বসে থাকতে পারি না। আমাদের এখনই সক্রিয় হতে হবে, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে এবং আমরা আর ফিরে আসতে পারব না- এমন পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, এ ধরনের জনগোষ্ঠী-নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনাসমূহ সব ওয়াসাকে তাদের পরিষেবা প্রদানের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে। আমি ওয়াটারএইডকে একটি কমন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সব ওয়াসার সঙ্গে এই ফলাফল ভাগ করে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
ঢাকা ব্রিটিশ হাইকমিশনের লাইভলিহুড অ্যাডভাইজার এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ টিমের ডেপুটি টিম লিডার এবিএম ফিরোজ আহমেদ বলেন, “এ ধরনের স্থানীয় নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনাসমূহ অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জলবায়ু সহিষ্ণু নগর উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এই পরিকল্পনাগুলো থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বর্তমানে চূড়ান্ত করা স্থানীয় জনগণ নেতৃত্বাধীন অভিযোজন কাঠামো এবং জাতীয় নগর নীতির জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হবে। সময়োপযোগী এই উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমি জিসিএ এবং এর অংশীদারদের ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কোনো নিবেদিত গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ নেই এবং আমরা প্রতিদিন এর অভাব অনুভব করি। এ ধরনের বিস্তারিত জনগোষ্ঠী-নেতৃত্বাধীন মূল্যায়ন আমাদের স্বল্প-আয়ের জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ পরিষেবা প্রদানে দিকনির্দেশনা দিতে সাহায্য করবে। জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনায় চিহ্নিত সমাধানগুলো আমাদের পরবর্তী বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
চট্টগ্রাম ওয়াসার সুপারেন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মাহবুবুল আলম বলেন, “জলবায়ু ঝুঁকি মূল্যায়ন ফলাফল এবং অভিযোজন পরিকল্পনায় চিহ্নিত সমাধানসমূহ সিডাব্লিউএসআইপির অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে স্বল্প-আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর আরো ভালোভাবে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। চট্টগ্রাম ওয়াসার চলমান ও আসন্ন প্রকল্প পোর্টফোলিও বিবেচনা করে আমি আশাবাদী যে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা স্বল্প-আয়ের জনগোষ্ঠীসহ সব নাগরিকের জন্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হব। তবে ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে, বিশেষ করে দ্রুত নগরায়ণের কথা বিবেচনা করে আমাদের একটি বিস্তারিত পানি উৎসের কৌশল তৈরি করার জন্য কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন। আমি ওয়াটারএইড এবং জিসিএকে এ বিষয়ে আমাদের সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করছি।”
(সিডাব্লিউএসআইপি) বিনিয়োগের জন্য তথ্য সরবরাহ করতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার অনুমোদনক্রমে ২০২৪ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আমার বার্তা/এমই