
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামের দুই বংশের ৫৫ বছরের দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বে ১৮টি খুন, সহস্রাধিক আহত, কয়েকশ বাড়িঘর একাধিকবার লুটপাট ভাঙচুর ও উভয়পক্ষের শতাধিক মামলা হয়েছে। গ্রামের দুই বংশের আধিপত্য বিস্তার ও শত্রুতাকে কেন্দ্র করে বার বার সংঘর্ষ, ঝগড়া লেগেই থাকত।
এসব বিরোধের নেপথ্যের নায়ক গ্রামের দুই ইউপি চেয়ারম্যান। একজন হলেন সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সরকার মো. সাফায়েত উল্লাহ। অপরজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মো. তোফাজ্জল হক। বর্তমানে চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ সরকার বংশের ও সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক কর্তা বংশের নেতৃত্ব দেন।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ দুই পক্ষকে মিলিয়ে দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে দেন। শনিবার সকালে দুই বংশের দুই নেতা মীমাংসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
উপজেলার এই মৌটুপী গ্রামটি এলাকায় দাঙ্গাবাজ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। গ্রামের মানুষগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মুরুব্বি কারো দোহাই মানে না। এমনকি পুলিশ মামলার আসামি ধরতে গেলে আসামি ছিনিয়ে রেখে পুলিশকে আটকে রাখার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার।
স্বাধীনতার পর ৫৫ বছরে কমপক্ষে শতবার সংঘর্ষ হয়েছে দুই বংশের মধ্য। সর্বশেষ কর্তা বংশের নাদিম ২০২৪ সালে খুন হন। এরপর সরকার বংশের ইকবাল খুন হন। ৫৫ বছরে দুই পক্ষের মধ্যে খুন হয়েছেন ১৮ জন। তার মধ্যে বর্তমান চেয়ারম্যানের আপন দুই ভাই কর্তা বংশের লোকজনের হাতে খুন হয়েছেন।
এরই মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দুই বংশের দুই নেতাসহ হাজারো লোকজন গ্রাম থেকে পালিয়ে যান মামলার ভয়ে। ২০২৪ সালে দুটি খুনের ঘটনায় উভয় পক্ষের শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট হয়। এসব ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলম কয়েকদিন আগে উদ্যোগ গ্রহণ করেন দুই বংশের ৫৫ বছরের বিরোধ মীমাংসার।
শরীফুল আলম আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর) আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন। তাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তারই নির্দেশে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুল ইসলামসহ দলের একাধিক নেতা মৌটুপী গ্রামের দুই বংশের দুই নেতার সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার প্রস্তাব করেন। তাদের প্রস্তাবে দুই পক্ষই সম্মতি দিলে গত সপ্তাহে দুই বংশের লোকজন মৌটুপী গ্রামে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকে আলোচনার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়- তারা ভবিষ্যতে আর কখনো ঝগড়া-সংঘর্ষে জড়াবে না। সামান্য বা তুচ্ছ ঘটনায় বিরোধ না করে মিলেমিশে মীমাংসা করবে। এ পর্যন্ত দুই পক্ষের যত মামলা মোকদ্দমা আছে তা আগামী সংসদ নির্বাচনের পর দুই পক্ষ বসে আলোচনার ভিত্তিতে বিএনপির নেতৃবৃন্দ মীমাংসার ব্যবস্থা করে দিবেন।
বিষয়টি মীমাংসার পর শুক্রবার দুপুরে এলাকার বিএনপি নেতা ভিপি সাইফুল হকের বাড়িতে দুই পক্ষের খাবারের আয়োজন করা হয়। খাবার আয়োজনে দুই বংশের দুই নেতা সরকার সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হকসহ উপজেলা বিএনপির সভাপতি রফিক এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও পৌর বিএনপির সভাপতি হাজী মো. শাহিন ও সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, যুবদল নেতা দেলুয়ার হোসেন সুজনসহ একাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে দুই বংশের দুই নেতা কোলাকুলি করেন ও মালা বিনিময় করেন। অঙ্গীকার করেন আর বিরোধ-শত্রুতা নয়। এখন থেকে মিলেমিশে গ্রামে বসবাস করবেন। এভাবেই ৫৫ বছরের বিরোধ শত্রুতার অবসান করে দেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
এ বিষয়ে বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা আর ভবিষ্যতে বিরোধে জড়িয়ে ঝগড়া, সংঘর্ষ করব না।
একই কথা বলেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. তোফাজ্জল হক। তারা দুজনই বলেন, ‘আমরা এখন থেকে ভাই ভাই হয়ে গ্রামে বসবাস করবো।’
এ ব্যাপারে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের নেতা শরীফুল আলমের নির্দেশে আমরা মৌটুপী গ্রামের ৫৫ বছরের শত্রুতার অবসান করে দিলাম।
সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, মৌটুপী গ্রামটিতে একটি কুচক্রী মহল যুগ যুগ ধরে দুই পক্ষকে বিবাদে জড়িয়ে রেখে ফায়দা লুটতো। মামলা মোকদ্দমা লাগিয়ে রাখতো। আমরা শুক্রবার এই দুই বংশের বিরোধ মীমাংসা করে গ্রামে শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি।
ভিপি সাইফুল হক বলেন, মৌটুপী গ্রামেই আমার বাড়ি। অনেক চেষ্টার পর দুই পক্ষের বিরোধ মীমাংসা করতে সফল হয়েছি।
আমার বার্তা/এল/এমই

