
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমাদের একটি চ্যালেঞ্জ ছিল যে ব্যাংক খাতের ওপর এক ধরনের আস্থা ধরে রাখা। আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি সেটি আমি বলবো না। আমরা আস্থা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। সেক্ষেত্রে আমরা আংশিকভাবে হয়তো সফল হয়েছি। আর দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটা স্থিতিশীলতা ফেরানোর ক্ষেত্রে আমরা বহুলাংশে সফল হয়েছি।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ব্যাংকিং সেক্টর রিফর্ম: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
নিজেদের অর্থেই রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব হবে জানিয়ে সেমিনারে গর্ভনর বলেন, আমাদের রিজার্ভ গত বছর আট বিলিয়নের উপর বেড়েছে। এ বছর অলরেডি দেড়-দুই বিলিয়নের মতো বেড়ে গেছে। আমাদের ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট নিয়ে কোনো শঙ্কার কারণ নেই। আমরা যেটা ভেবেছিলাম, হয়তো দু-তিন বছর লাগবে, কিন্তু সেটা প্রথম বছরেই অর্জন করে ফেলেছি। আমরা প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি বাজার থেকে কিনেছি, আরও কিনবো যখনই দরকার হবে।
তিনি বলেন, আমাদের পলিসি হচ্ছে, আমাদের রিজার্ভ আমাদেরই বাড়াতে হবে। ধার করে আইএমএফ থেকে অর্থ নিয়ে বা বিশ্বব্যাংকের অর্থ নিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব নয়। এটি উচিতও নয়। আমাদের রিজার্ভ আমরাই বাড়াবো। আমাদের অর্থনীতি থেকে আমরা টাকা নেবো।
এ বছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো সরকারের লক্ষ্য, এ কথা উল্লেখ করে গর্ভনর বলেন, আমাদের রিজার্ভ আমাদেরই বাড়াতে হবে। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো ঠিক নয়। এ বছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ ৩৪ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেওয়া আমাদের লক্ষ্য। আইএমএফ টাকা দিক বা না দিক, আমরা এ লক্ষ্য পূরণে চেষ্টা করবো।
তিনি বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে গভর্নেন্সের অভাব ছিল। এটি ব্যাপকভাবে ছিল, কিছুটা কমেছে, কিন্তু এখনো আছে।
মন্দ ঋণ বা খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আমাদের এনপিএল (মন্দ ঋণ) হয়তো পৃথিবীর অন্যতম হায়েস্টের মধ্যে। ডিসেম্বরের মধ্যে মন্দ ঋণ কিছুটা কমে যাবে। সর্বশেষ মন্দ ঋণ ৩৬ শতাংশ হয়েছে, অনেকেই এ তথ্য প্রকাশ করতে মানা করেছিলেন। কিন্তু আমরা প্রকাশ করেছি। আমরা ভুল ডাটা বা মিথ্যা ডাটা দিতে প্রস্তুত নই। আমরা বলেছি, আমরা প্রকৃতপক্ষে যে অবস্থায় আছি সে তথ্য প্রকাশ করবো এবং সেখান থেকেই উত্তরণ ঘটাবো।
কোনো ব্যাংকের অবস্থা ভালো থাকলে সেখানে হস্তক্ষেপ করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক যদি ভালো না হয়, আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করবো। সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক এখন খুব ভালো অবস্থায় রয়েছে। এর সব কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সাইন বোর্ড দু-একদিনের মধ্যে পরিবর্তন করা হবে। আমি মনে করি এই ব্যাংক ঘুড়ে দাঁড়াবে। এখানে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, তারল্য সংকট কাটাতে ইসলামী ব্যাংককে ১০ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর তারা আর কোনো অর্থ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তারা নিজেরাই ডিপোজিট সংগ্রহ করেছে। ব্যাংকটির অবস্থা এখন ভালো।
সেমিনারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থনীতির সব সূচকই দুর্বল অবস্থায় ছিল। অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সংস্কারগুলো দৃশ্যমান হয়েছে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে। সংস্কারের ফলাফল পুরোটা দেখতে পাইনি। এরজন্য সময় প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি মন্দ ঋণ ১১ থেকে ১২ শতাংশ ছিল। মন্দ ঋণ এখন ৩৬ শতাংশ। বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ মন্দ ঋণ।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঋণ বিতরণে পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক যোগসূত্রে কোনো ধরনের পেশাদারত্ব বিবেচনা না করেই ঋণ দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার পুনঃতফসিল করা হয়েছে। মন্দ ঋণ এখন ১২ থেকে ৩৬ শতাংশ হয়ে গেছে। বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকে মন্দ ঋণের পরিমাণ আরও বেশি৷ মন্দ ঋণ বা ঋণ খেলাপির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের উপরের দিকে রয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকের একীভূতকরণ কোনো সহজ কাজ নয়। এটি ম্যাজিক কোনো সমাধানও নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একীভূতকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখতে হবে।
আমার বার্তা/এমই

