প্রকৃত মানুষ করার জীবনব্যাপী সকল আয়োজনই শিক্ষা। একটি জাতি তথা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। কিন্তু শিক্ষা মানবসভ্যতার বিকাশের অন্যতম প্রধান উপাদান হলেও আজ তা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে কেবল জিপিএ-৫, সার্টিফিকেট অর্জন অথবা চাকরি পাওয়ার মধ্যে। কিন্তু পাশ করা ও শিক্ষিত হওয়া এক বিষয় নয়। তাই পাশের হার বাড়লেও শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে না। সন্তান কতোটা মানবিক জ্ঞান সম্পন্ন হলো, কতোটা সুশিক্ষিত হলো সেদিকে আমাদের খেয়াল নেই। সবাই আমরা ব্যস্ত কেবল নিজেদেরকে নিয়ে। অর্থের বিনিময়ে অর্জিত শিক্ষায় দেশপ্রেম, ভদ্রতা, সভ্যতা, মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রায় বিলুপ্ত। সমাজে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের বড্ড অভাব। তাই আমাদের স্লোগান-‘কেবল নয় ফলাফলমুখি শিক্ষা; বিকশিত হোক মানবতার দীক্ষা’। এ কথা সত্য, যে শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায় না, বিবেক জাগ্রত করে না, মনের দিগন্ত প্রসারিত করে না, মানবতাবোধ জাগ্রত করে না তা প্রকৃত শিক্ষা নয়। তাই শিক্ষা হতে হবে মানবিক ও নৈতিকতা নির্ভর যা শিক্ষার্থীর নৈতিক মানদন্ডকে উন্নত করার পাশাপাশি অন্তরের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করবে। কারণ নৈতিকতা বিবর্জিত বিদ্বান ব্যক্তি সমাজ সংস্কারে কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের বিষয়টি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক এই ত্রিভূজ সম্পর্কের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষার সামাজিক প্রভাব কী? সমাজ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে মেধা না অর্থ? সম্মানিত কে অর্থশালী না বিদ্বান? মানুষ ছুটছে অর্থ না বিদ্যার পেছনে? জাতির মেরুদন্ড কি শিক্ষা না অর্থনীতি? শিক্ষা কি সমাজ গড়ছে না সাম্রাজ্য? আমাদের রোল মডেল কি দুর্নীতিবাজ না সস্তা জনপ্রিয়তার কেউ? শিক্ষার উদ্দেশ্য কি সমস্যার সমাধান না অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো? শিক্ষা কি আমাদের বিবেককে প্রসার ঘটাচ্ছে না অন্ধ অনুকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে? মানুষ কি বিবেকের প্রেরণায় না হুজুগে চলছে? মুক্ত চিন্তার প্রকাশ কোথায়? তরুণ সমাজের লক্ষ্য কী? শিক্ষা কি আজ মানুষকে রোবট বানাচ্ছে? সমাজের আলোচনার বিষয়বস্তু কী? আমরা শিক্ষিত হচ্ছি কুশিক্ষায় না সুশিক্ষায়?
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতা আর উদারতা প্রায় ম্রিয়মাণ। সমাজ হয়ে পড়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বার্থপর ও অসহিষ্ণু। দৃষ্টি কেবল স্বার্থের চোখে নিবদ্ধ, মানবিকতার চোখ কার্যত অন্ধ। আমাদের তরুণ সমাজের কাছে আজ সবচেয়ে বড় সংকট অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের। কাকে অনুসরণ করে স্বপ্ন বুনবে, কার চরিত্র অনুকরণ করবে, কার আর্দশে নিজেকে আলোকিত করবে তার কোনো সমাধান নেই। তাই আমরা দেখতে পাই নৈতিকতা বিবর্জিত এ সমাজে বড় অপরাধীরাও বড় ডগ্রিীধারী। অন্তত পুঁথিগত বিদ্যায় তারা বেশ এগিয়ে।
সম্জা জীবনে স্নেহ-প্রীতি-ভালবাসা প্রায় অবলুপ্ত, মানবতা-নৈতিকতা-উদারতা বিলীন প্রায়, শ্রদ্ধা-বিনয় অদৃশ্য, দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারে সামাজিক পরিমন্ডল কলুষিত। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপহরণ, ইত্যাদি স্বাভাবিক জীবনকে ছন্দহীন করে তুলেছে। মাদক, কিশোর গ্যাং, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, শিশুধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অপকর্মের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমাদের শিশু-ছাত্র-যুবারা দিন দিন মানসিকভাবে আহত হয়ে বিপথগামী হতে চলেছে। এই অবস্থা একটি জাতির জন্য খুবই ভয়ংকর। তাই আজকের তরুণ প্রজন্মকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যে প্রজন্ম কবেল প্রাতিষ্ঠানিক ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে না তারা হবে ছোটদের প্রতি স্নেহশীল, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, দেশপ্রেম উজ্জীবিত। তারা অন্যের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে এবং সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটাবে। সৃজনশীল বিকাশ ছাড়া সমাজকে আলোকিত করা সম্ভব নয়। আলোকিত তরুণরাই হবে আলোকিত ভবিষ্যত।
একজন মানুষের চিন্তা, কর্ম, আচরণের প্রভাবের সুতিকাগার হচ্ছে পরিবার। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, নীতি-নৈতিকতা কিংবা অন্যের মতামত গ্রহণ করার মতো মানসিকতার শিক্ষা পরিবার থেকেই নিতে হয়। শিশুর প্রথম শিক্ষালয় তার পরিবার এবং প্রথম শিক্ষক তার মাতা-পিতা। সেহেতু শিশুকে পারিবারিক মূল্যবোধ, উন্নত চরিত্র, সৎ আদর্শবান নাগরিক ও উন্নত চরিত্রের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রধান হচ্ছে পরিবার। তাই শিশুদের নৈতিকভাবে বিকশিত করতে হলে পরিবারের সদস্যদের নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় মানুষ যেমন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত তেমনি ধ্যান ধারণা ও চিন্তায় এসেছে নানা পরিবর্তন। কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই সততা ও নৈতিকতার মূর্ত প্রতীক কিংবা সহানুভূতির প্রতিচ্ছবি না হতে পারি, তবে তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করা কিংবা উন্নত মানুষ গড়া প্রায় অসম্ভব। বাবা/মা রাত ১২টায় ঘরে ফিরে যদি প্রত্যাশা করে তার সন্তান সন্ধ্যায় ঘরে ফিরবে তা কি হয়? বাবা-মা এবং অভিভাবকগন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সন্তানদেরকে নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে সাটিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় প্রলুব্ধ করছে। সন্তান ভ‚মিষ্ট হওয়ার পর থেকেই এক আসুস্থ প্রতিযোগীতায় লিপ্ত। কার সন্তান কত শিক্ষিত হলো, কার পরীক্ষায় কি রেজাল্ট হলো, কে কোথায় পড়ে, পড়া শেষে কী করবে, কার ছেলে বিজ্ঞানী হলো, ইঞ্জিনিয়ার হলো যা মুখ্য আলোচনার বিষয়বস্তু হলেও নীতি- নৈতিকতা, মানবিকতা, দেশপ্রেম কিংবা সত্যিকারের মানুষ হয়ে গড়ে উঠার বিষয়ে কোন প্রকার আলোকপাত নেই।
শিক্ষকতা মহান পেশা/ যারা মানুষের শ্রদ্ধা, আদর্শ ও অনুকরণের প্রেরণা। মহানুভবতা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সচ্চরিত্রের মতো মানবীয় গুণাবলীর জন্য একজন শিক্ষক সকলের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে উঠেন। মানবিক মূল্যবোধের এ সকল গুণাবলি সমাজ জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। শিক্ষক হয়ে উঠেন গুরু, ছাত্র হয় শিষ্য। শিক্ষক ছাত্রকে শুধু শিক্ষা নয় সাথে দেন দীক্ষাও। কারণ শিক্ষকদেও দায়িত্ব শুধু পাঠদান, সিলেবাসের প্রশ্ন শেখানো কিংবা পরীক্ষায় পাশ করানো নয়। বরং শিক্ষার্থীদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, মানবিক মানুষ তৈরী, বিবেকবোধ জাগ্রত করা, উন্নত চরিত্র গঠন যা তাদেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ছাত্র-ছাত্রীদেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিমুখতা, শিক্ষকের বিরুদ্ধাচরণ কিংবা শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন, দলাদলি আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক সাধারণ চিত্র। আবার অনেক শিক্ষকও হয়ে পড়েছেন বাণিজ্যমুখী। তাই ক্লাসের থেকে কোচিং-প্রাইভেটেই মনোযোগ বেশি। বিদ্যা আজ বাক্সবন্দী, পড়াশোনা কেবল পরীক্ষামুখী। বিদ্যালয়গুলো এখন কেবল পাশের হার, গ্রেড আর নম্বরের পেছনে ছোটাছুটি। কি শেখানো হচ্ছে আর কি শেখানো দরকার তা নিয়ে কোনো আয়োজন নেই; নেই কোনো লাগসই পরিকল্পনা।
শিক্ষার্থীরা আজ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেমন আপন করে ভাবতে পারছে না তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ বা আকর্ষণের জায়গা হিসেবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। পড়ালেখা যেন তাদের কাছে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা, সার্টিফিকেট প্রাপ্তিই এর মূল উদ্দেশ্য। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পরীক্ষার আগে ও পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপ, হতাশা ও ক্লান্তি এমনভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে যে, তারা কখনো কখনো পরীক্ষাকেন্দ্র ভাঙচুরের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় লিপ্ত হচ্ছে। এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নৈতিক ও মানসিক দুর্বলতার প্রতিফলন। একারণেই শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধের স্থানটি আজ অনেকটা বিবর্ণ। ছাত্রসমাজের সামনে আজ অনুকরণী অনুসরনীয় ব্যাক্তিত্বের বড় অভাব। পাঠদান কেবল পাঠ্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বইয়ের বাইরে শেখা হচ্ছে না কিছুই। মানসম্মত শিক্ষক না থাকায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশ আজ কেবল অতীতস্মৃতি। সমাজে আজ আদর্শবান ব্যক্তির অভাব, বিত্তবানরাই যেন আদর্শ, আর পেশিশক্তির অধিকারীরাই যেন সমাজপতি। তাই সমাজ আর গড়ে উঠছে না, উঠছে সাম্রাজ্য। চাকুরি পাওয়া বা আর্থিকভাবে সচ্ছলতা আনতেই ব্যস্ত মুখস্থনির্ভর আজকের শিক্ষা-সংস্কৃতি। ফলে বিত্ত-বৈভব আর প্রাচুর্যে জীবনকে রাঙিয়ে তোলার প্রবল বাসনায় ব্যক্তি বা সমাজের জন্য মহৎ কিছ ুকরার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের মূল চালিকাশক্তি- সততা ও নিষ্ঠার মতো মানবিক গুণাবলি। আমরা ভুলেই যাচ্ছি জীবন শুধুই একটি ভ্রমণযাত্রা, কোনো প্রতিযোগিতা নয়।
আমরা যদি সত্যিই একটি উন্নত, মানবিক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে হতে হবে আনন্দময় ও অংশগ্রহণমূলক। যে শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক মানদণ্ডকে উন্নত করার পাশাপাশি তার ভেতরকার মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকবে উৎসবমুখর পরিবেশ। শিক্ষকরা হবেন সকলের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, অভিভাবকদের লক্ষ্য শুধু ভালো ফলাফল নয়; লক্ষ্য হবে আদর্শ মানুষ গড়ার। যারা হবে মেধাবী, মানবিক, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক প্রজন্ম। যেখানে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে থাকবে না কোনো ভয়, থাকবে না কোনো শঙ্কা। সম্পর্কের ভিত্তি হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। প্রযুক্তির পরিবর্তনকে আলিঙ্গন এবং প্রযুক্তির মত উন্নত সংস্করণে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে যোগ্যতার মানদণ্ডকে উন্নীত হবে। এরূপ শিক্ষা কেবল মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেক জাগ্রত করবে না, বরং শিক্ষার্থীকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে কর্মপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করবে এবং জীবনের গভীর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলবে। তাহলেই আগামী প্রজন্মের কাছে এ দেশ থাকবে নিরাপদ। অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ। কারণ তরুণরাই গড়বে আগামীর বাংলাদেশ।
লেখক: জেলা প্রশাসক, নারায়ণগঞ্জ।
আমার বার্তা/মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা/জেএইচ