ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি কেবল সমুদ্রকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটি গতানুগতিক ধারণা নয়; এটি মানবজাতির জন্য সমুদ্রের সম্পদ ও সেবাকে টেকসই, সমতাভিত্তিক এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহারের একটি সামগ্রিক কৌশলগত দর্শন। ব্লু ইকোনমি'র মূল কথা হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গিয়ে যেন সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য (Ocean Health) বিন্দুমাত্র বিঘ্নিত না হয়। এই দর্শনটি মৎস্য আহরণ থেকে শুরু করে শিপিং, উপকূলীয় পর্যটন, নবায়নযোগ্য সামুদ্রিক শক্তি এবং মেরিন বায়োটেকনোলজির মতো অ-প্রথাগত খাতগুলির সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় রাষ্ট্রের জন্য এটি একুশ শতকের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, যেখানে বিশাল জলসীমা বিজয়ের পর আমরা সমুদ্রভিত্তিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের প্রয়োজন দ্রুত প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে এসে, গভীর সমুদ্রের অফুরন্ত সম্ভাবনা এবং তার টেকসই ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেওয়া।
আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল জলরাশি এবং এর অন্তর্গত মৎস্য সম্পদ কেবল একটি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যখন আমরা ব্লু ইকোনমি'র (নীল অর্থনীতি) স্বপ্ন দেখি, তখন এর কেন্দ্রে থাকে এই অপার জলজ সম্পদের টেকসই ও দায়িত্বশীল ব্যবহার। মৎস্য সম্পদের এই টেকসই ব্যবস্থাপনা কোনো বিচ্ছিন্ন ধারণা নয়; এটি সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, এবং ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা—এই তিনের এক সুসংহত মেলবন্ধন। দেশের মোট জিডিপিতে (GDP) মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপিতে এই হার ২৫ শতাংশেরও বেশি। দেশের প্রায় ১.৯৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের উপর নির্ভরশীল, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ। খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে, আমাদের দৈনন্দিন প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশের বেশি আসে মাছ থেকে।
বর্তমানে, আমাদের মৎস্য খাত একটি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন: একদিকে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর চাপ, অন্যদিকে, অতিরিক্ত মাছ ধরা (Overfishing) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট পরিবেশগত অবনতি। যদি আমরা এই মূল্যবান সম্পদকে ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত রাখতে চাই, তবে গতানুগতিক মৎস্য আহরণ পদ্ধতি থেকে সরে এসে গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণ এবং নিয়ন্ত্রিত জলজ চাষ (Aquaculture) এর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কেবল উপকূলের কাছাকাছি মাছের ওপর নির্ভর না করে, আমাদের উচিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং গবেষণার মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে সম্পদের সন্ধান করা। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রে আমাদের প্রায় ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এর সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, এবং আন্তর্জাতিক মানের ফিশিং ট্রলারের ব্যবহার, যা একইসাথে সমুদ্রে নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করবে।
কৃত্রিম প্রজনন ও জলজ চাষের বৈপ্লবিক ভূমিকা (Revolutionary Role of Hatchery and Aquaculture) এই প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি। অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় জলজ চাষের ক্ষেত্রে আমাদের কেবল রুই, কাতলা বা চিংড়ির মতো প্রচলিত প্রজাতির উপর নির্ভর না করে, উচ্চ মূল্যের সামুদ্রিক প্রজাতি (High-Value Marine Species) চাষের দিকে যেতে হবে। এটি ইতিবাচক যে, বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে, যার প্রধান কারণ হলো অভ্যন্তরীণ জলজ চাষে প্রায় ১১ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি। বায়োফ্লক (Biofloc) বা রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম (RAS)-এর মতো প্রযুক্তিগুলি ব্যবহার করে সীমিত জায়গায় মাছের উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব, যা একইসাথে পানির ব্যবহার কমায় এবং পরিবেশের উপর চাপ হ্রাস করে। এই পদ্ধতিগুলি গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন সুযোগ তৈরি করবে। মৎস্য রপ্তানি থেকে আমাদের বার্ষিক আয় বর্তমানে ৪,০০০ কোটি টাকারও বেশি, যা টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব।
টেকসই ব্যবহারের মূল ভিত্তি হলো তথ্য-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (Data-Driven Management)। কোথায়, কখন, এবং কতটুকু মাছ ধরা হচ্ছে—এই সমস্ত তথ্য নির্ভুলভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। মৎস্য প্রজাতির প্রজনন সময়কালে কার্যকরভাবে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা এবং সংরক্ষিত সামুদ্রিক অঞ্চল (Marine Protected Areas) প্রতিষ্ঠা করা এই ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এছাড়াও, ছোট পর্যায়ের জেলেরা যাতে আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ পায়, তা নিশ্চিত করা জরুরি। তাদের প্রথাগত জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে একত্রিত করে একটি সহ-ব্যবস্থাপনা (Co-management) মডেল তৈরি করতে পারলে স্থানীয় পর্যায়ে সম্পদের অপচয় ও অবৈধ মাছ ধরা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। অবৈধ, অনিয়ন্ত্রিত ও অনথিভুক্ত (IUU) মৎস্য শিকার রোধ করা এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং পুরো ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। অত্যাধুনিক মনিটরিং ও নজরদারি ব্যবস্থা যেমন স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং (VMS) ব্যবহার করে মাছ ধরার নৌযানগুলোকে সার্বক্ষণিক তদারকির আওতায় আনাটাও জরুরি।
ব্লু ইকোনমি'র পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে সামুদ্রিক দূষণ রোধে কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং তেল নিঃসরণ আমাদের জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য নীরব ঘাতক। সরকারকে এক্ষেত্রে আরও কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি উপকূলীয় শিল্পগুলিকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে যেতে উৎসাহিত করতে হবে। মৎস্য সম্পদ শুধু পেট ভরানোর উপায় নয়; এটি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি, যা আমাদের জিডিপি'তে (GDP) উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের উপকূলীয় অবকাঠামোকে আরও সহনশীল করে তুলতে হবে এবং ম্যানগ্রোভ বন (যেমন সুন্দরবন) সুরক্ষার উপর জোর দিতে হবে, যা একদিকে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে রক্ষা করে।
এই স্বপ্ন কেবল মাছ ধরার পরিমাণ বাড়ানো নয়; এটি আমাদের সমুদ্রকে সুস্থ রাখা, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ জলজ উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার। আর এই অঙ্গীকার পূরণের চাবিকাঠি নিহিত আছে মৎস্য সম্পদের ভারসাম্যপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার মধ্যে, যেখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং নীতিগত দূরদর্শিতা একত্রে কাজ করবে।
লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ।
আমার বার্তা/সাকিফ শামীম/এমই