ঢাকার লালবাগ কেল্লার প্রবেশ ফটক দিয়ে ভেতরে যেতেই স্বাগত জানালেন দুজন প্রহরী, যেন সেই মুগল যুবরাজ মুহম্মদ আজমের অন্দরমহল।
সেখানেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্মবার্ষিকী রাঙিয়ে তোলা হয়েছে রঙিন আলোর ঝলক আর ধ্রুপদী সুরের মূর্ছনায়।
আলাউদ্দিন খাঁর ১৬৩তম জন্মবার্ষিকীতে বুধবার রাতে বসে সুরের জলসা। সে জন্য লালবাগ কেল্লার ভেতরে করা হয় আলোকসজ্জা। ছিল সাজ সাজ রব, যেন যুবরাজের অন্দর মহলের কোনো জমকালো আয়োজন।
সে আয়োজনে সামিল হতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে বিকাল থেকেই লালবাগ কেল্লার ফটকের সামনে অপেক্ষা করছিলেন সামিহা ও রাসেল নামের দুজন শিক্ষার্থী।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্মদিনকে ঘিরে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরের খবর ফেইসবুকে জেনে এসেছিলেন তারা। কিন্তু আমন্ত্রণপত্র না থাকায় তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
রাসেল আমার বার্তাকে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক থেকেও এই অনুষ্ঠানটি নিয়ে প্রচার করা হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমিও ফেইসবুকে আয়োজনটি নিয়ে প্রচার করেছে। কিন্তু অনুষ্ঠানটি যে শুধুমাত্র আমন্ত্রিতদের জন্য, তা তারা স্পষ্ট করেননি। এরকম জনবিচ্ছিন্ন ভিআইপি আয়োজন করা হলে, তাও বলে দেওয়া উচিত।”
শুধু রাসেল ও সামিহা নন, এমন আরো অনেকেই কেল্লার ফটকে অপেক্ষা করেও ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের কেউ কেউ ফটকে থাকা আয়োজকদের কাছে ক্ষোভও প্রকাশ করেন।
প্রবেশধাধিকার সংরক্ষিত রাখার কারণ জানতে চাইলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক শেখ রেজাউদ্দিন আহমেদ (রেজাউদ্দিন স্টালিন) আমার বার্তাকে বলেন, “আমরা কিন্তু গেইটে যারা ছিলেন, তাদেরকে বলেছি ‘ই-কার্ড’ দেখালেও যেন প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। এরপরও কেউ কেউ প্রবেশ করতে পারিনি। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আসলে জায়গা সংকুলানের কারণে অনুষ্ঠানটি পুরোপুরি উন্মুক্ত রাখা সম্ভব হয়নি।”
ধ্রুপদী সুরের মূর্ছনা
“আজকে আমি যে সরোদটি বাজাচ্ছি, এটি আমার বড় বাবার সরোদ। এটি আনুমানিক দেড়শ বছরের পুরনো,” বলেন তার প্রপৌত্র।রাত ৮টার দিকে খেয়াল (রাগ-ভীমপলশ্রী) নিয়ে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত অসিত দে।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একটি ভিডিও বার্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্যে বলেন, “বিশ্ব সংগীতের ভুবনে কিংবদন্তিতুল্য এক ব্যক্তিত্ব ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে তিনি বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লায় তার জন্মদিন উদযাপনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ববহ।”
পরে পর্দায় দেখানো হয় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র। আধা ঘণ্টার চা বিরতির পর ফের শুরু হয় অনুষ্ঠান। রাত যত বাড়তে থাকে অনুষ্ঠানও যেন জমে উঠতে শুরু করে।
অনুষ্ঠান মঞ্চে শুভেচ্ছা বক্তব্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “আমরা এখানে যখন দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান করছি। তখন গাজা অভিমুখে যাওয়া মানবাধিকারকর্মীরা বন্দি হয়েছেন। আমরা তাদের মুক্তির দাবি জানাই। ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানাই।”
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আর খুব বেশি দেরি নেই; অবশ্যই আগ্রাসনের পরাজয় হবে। ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের সংহতি থাকবে। ইতোমধ্যে অনেকেই ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। গাজার মানুষ মুক্ত হবে।”
এ সময় দর্শক সারি থেকে স্লোগান ওঠে 'ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন'। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও।
রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে রাগ কিরওয়ানি পরিবেশন করেন বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন মৈত্রী সরকার।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন অভিজিৎ কুন্ডু (কণ্ঠ-ধ্রুপদ), প্রশান্ত ভৌমিক (তবলা), ফাহমিদা নাজনীন (তবলা), শুক্লা হালদার (এস্রাজ), নিলয় হালদার (সারেঙ্গি), ইসরা ফুলঝুরি খান (সরোদ), ইলহাম ফুলঝুরি খান (সরোদ), সোহিনী মজুমদার (সেতার), মোহাম্মাদ কাওছার (সেতার)।
অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে কথোপকথনে অংশ নিয়ে আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন বলেন, “ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের সাথে বিপ্লবী চে গেভারার দেখা হয়েছিল। কলকাতা শহরে তখন আলাউদ্দিন খাঁ মাইহার থেকে এসেছিলেন। এখানেই চে এবং আলাউদ্দিন খাঁর দেখা হয়।
“যে লালবাগ কেল্লায় আজকে ওস্তাদের জন্মদিন উদযাপন করা হচ্ছে। এইখানেও তিনি এসেছিলেন। এখানে তিনি এসে সরোদ বাজিয়েছিলেন।”
সবশেষে মঞ্চে আসেন অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান। তিনি পরিবেশনা শুরুর আগে বলেন, “আজকে আমি যে সরোদটি বাজাচ্ছি, এটি আমার বড় বাবার সরোদ। এটি আনুমানিক দেড়শ বছরের পুরনো। আমার পরিবার থেকেই সরোদটি পাওয়া।”
পরে সরোদের সুরে মুগ্ধতা ছড়ান সিরাজ আলী খান। তার সহযোগী শিল্পী হিসেবে ছিলেন কল্লোল ঘোষ ও আর্চিক ব্যানার্জী (তবলা)।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন এবং মারিয়া ফারিহ্ উপমা।
শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এই সঙ্গীত আসরের আয়োজক ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাপান, ইতালি, চায়না, পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন, বতসোয়ানা ও ইউনেস্কাসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা।
অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক শেখ রেজাউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক তানজিম ইবনে ওয়াহাব।