উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে চীনের সামুদ্রিক অর্থনীতি এখন পরিণত হয়েছে ‘নীল প্রবৃদ্ধি’র শক্তিশালী ইঞ্জিনে। প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ইউয়ানের (প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) বেশি মূল্যমানের এই খাত বর্তমানে চীনের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। ২০২৪ সালে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, যা দেশটির সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি।
চীন এরই মধ্যে সামুদ্রিক অর্থনীতিকে জাতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছে। জুলাইয়ের শুরুতে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে দেশটির শীর্ষ নেতৃত্ব জানায়, চীনা আধুনিকায়নের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী হওয়ার নিজস্ব পথ অনুসরণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা পাঁচটি মূল ক্ষেত্র নির্ধারণ করেছেন: উদ্ভাবনভিত্তিক প্রবৃদ্ধি, সমন্বিত উন্নয়ন, শিল্প আধুনিকায়ন, সমুদ্র ও মানুষের মধ্যে ভারসাম্য, এবং যৌথ সহযোগিতা।
জৈবপ্রযুক্তি থেকে অফশোর জ্বালানি পর্যন্ত—চীনের সামুদ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নকে এগিয়ে নিচ্ছে উদ্ভাবন।
চীনের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরের শহর চিংদাও-তে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিজি১৩৬ নামে একটি নতুন অ্যান্টি-টিউমার ওষুধের ফেজ-২ ট্রায়াল শুরু করেছে। এই ওষুধ তৈরি হচ্ছে সামুদ্রিক উৎস থেকে প্রাপ্ত যৌগ দিয়ে।
চীনের প্রকৌশল অ্যাকাডেমির সদস্য গুয়ান হুয়াশি জানান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ উদ্ভাবনী গবেষণা দলগুলোকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিচ্ছে এবং ‘ব্লু মেডিসিন ব্যাংক’ প্রকল্প চালু করেছে। এর লক্ষ্য সামুদ্রিক ওষুধের পূর্ণ গবেষণা ও বাণিজ্যিকীকরণ চেইন গড়ে তোলা।
২০২৫ সালের চীনা সামুদ্রিক অর্থনীতির সূচক অনুযায়ী, উদীয়মান সামুদ্রিক শিল্পগুলোর মূল্য সংযোজন ২০২৪ সালে ৭ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে সামুদ্রিক চিকিৎসা, বায়োপ্রোডাক্ট ও উচ্চপ্রযুক্তি অফশোর যন্ত্রপাতি উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের বেইবু উপসাগরে ৮০টিরও বেশি অফশোর উইন্ড টারবাইন থেকে উৎপন্ন হচ্ছে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ। গুয়াংজির ফাংচেংগাং-এ প্রথম অফশোর উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পুরোপুরি গ্রিডে যুক্ত হয়েছে।
সবুজ রূপান্তর ও বৈশ্বিক সংযোগ
উদ্ভাবনের পাশাপাশি সবুজায়নের পথেও দ্রুত এগোচ্ছে চীনের সামুদ্রিক খাত। জুনে গুয়াংঝৌ শিপইয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ কোরিয়ার এক ক্লায়েন্টের জন্য ২৩০ মিটার দীর্ঘ এলএনজি দ্বৈত-জ্বালানি (ডুয়াল ফুয়েল) গাড়িবহনকারী জাহাজ নির্মাণ শুরু করেছে। জাহাজটি জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উভয় দিয়েই চলবে।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক ঝোউ সুহুই জানান, তাদের ৯০টির বেশি জাহাজ নির্মাণ অর্ডারের মধ্যে ৮০ শতাংশই ‘সবুজ প্রযুক্তি নির্ভর’ এবং উচ্চমূল্য সংযোজন সম্পন্ন।
২০২৩ সালে বিশ্ববাজারে সবুজ জাহাজ নির্মাণের নতুন অর্ডারের ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।
পরিবেশ রক্ষায় ডিজিটাল প্রযুক্তি
ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ রক্ষার কাজও জোরালো হয়েছে। শানডং প্রদেশের দোংইং শহরে ৬২৯টি উপকূলীয় বর্জ্য নিঃসরণ মুখের জন্য তৈরি হয়েছে ডিজিটাল রেজিস্ট্রি। শেনঝেনের দাপেং উপসাগরে ড্রোন ও স্পেকট্রাল ইমেজিং ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধতা যাচাই করা হয়। শিয়ামেনে এআই-ভিত্তিক ভিডিও সিস্টেম দিয়ে খুঁজে বের করা হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের ভাসমান প্লাস্টিক ও বর্জ্য।
এতে ইতিবাচক ফলও মিলছে। ২০২৪ সালে চীনের ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ উপকূলীয় পানি ‘ভালো মানের’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
নিচু স্তরে, চেচিয়াং প্রদেশে ‘ব্লু সার্কেল’ নামে একটি প্রযুক্তিনির্ভর প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার প্রকল্প ব্লকচেইন ও আইওটি ব্যবহার করে ১৯ হাজার টনেরও বেশি সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। এতে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ যুক্ত হয়েছেন এবং ২০২৩ সালে এই প্রকল্পটি জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ভবিষ্যতের দিকচিহ্ন
২০২৫ সালে ফ্রান্সের নিস শহরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ মহাসাগর সম্মেলনে চীনের সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নেতৃত্বের ভূমিকাকে প্রশংসা করা হয়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ট্রপিক্যাল ফরেস্ট অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক জ্যাক হার্ড বলেন, মহাসাগরে এবং স্থলভাগে চীনের যা অগ্রগতি, তা সত্যিই চমৎকার।
উন্নত প্রযুক্তি, সবুজ রূপান্তর এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বের মাধ্যমে চীনের সামুদ্রিক অর্থনীতি আজ শুধু দেশীয় উন্নয়নের মূলভিত্তি নয়, বরং বিশ্বমঞ্চেও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে। সূত্র: শিনহুয়া, ইউএনবি
আমার বার্তা/জেএইচ